পাঠ্যবই পরিবর্তন, সমতার পরিবর্তে লিঙ্গ বৈষম্য

প্রশান্তি ডেক্স ॥ নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিঙ্গ সমতা তৈরির লক্ষ্যে ২০২৪ সালের দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে ‘আমার বাড়ির কাজ’ শিরোনামে কথোপকথনের মাধ্যমে একটি গল্প সংযোজন করা হয়েছিল। সেই বই পরিমার্জন করা হয় ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য। আগের পাঠ্যবইয়ে ‘তুলি বাজারে যেতে চেয়েছিল’ সংশোধন করা পাঠ্যবইয়ে এবার ‘তুলি ঘরে কাজ করতে চেয়েছে’। এই পরিবর্তনকে লিঙ্গ সমতা নষ্ট করে শিশুদের লিঙ্গবৈষম্য শেখানোর উদ্যোগ বলে অভিযোগ উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। তবে পরিবর্তনের পক্ষেও অনেকে মতামত দিয়েছেন।

‘কাপড় ধোয়া’, ‘ঘর গোছানো’ এসব কাজ যে শুধু নারীর কাজ নয়, নারী-পুরুষ সবাই পরিবারের সব কাজ করবে- এ বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছিল ২০২৪ সালের ‘আমার বাড়ির কাজ’ শিরোনামের গল্পের কথোপকথনে।

শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা জানান, গল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নারী ও পুরুষের কাজ সুনির্দিষ্ট না করে সব যে ভাগাভাগি করা যায়, শিশু শিক্ষার্থীদের সেই শিক্ষা দেওয়া। কথোপকথনও সাজানো হয়েছিল সেভাবে। যাতে নারী ও পুরুষের সমতা তৈরি হয় প্রতিটি শিশুর মধ্যে। নারীকে যেন শিশুরা খাটো করে দেখার শিক্ষা না পায়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে চেয়ারম্যান (এনসিটিবি) জানিয়েছেন, পরিবর্তনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের এখতিয়ার। তারাই এ নিয়ে বলতে পারবেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু পাঠ্যবইয়ের এই পরিবর্তনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এ পরিবর্তন অশনি সংকেত।’

পাঠ্যবইয়ে এ ধরনের পরিবর্তন রোধ করতে হবে উল্লেখ করে ডা. মালেকা বানু বলেন, ‘ছেলেমেয়ে সবাইকে ঘরে এবং বাইরে কাজ করতে হবে, কাজ করতে হয়। কিন্তু মন-মানসিকতা তৈরি করতে হবে ছোট থেকেই। শিশু মনে পরিবর্তনটা আনতে হবে। জেন্ডার বৈষম্য রোধে অনেকদিন থেকেই আন্দোলন হচ্ছে। আমরা দেখছিলাম কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। সেই জায়গায় আবার যদি এভাবে পাঠ্যবইয়ে ফেরত নিয়ে আসা হয়, তাহলে আমরা আবার পেছনের দিকে চলে যাবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু এই একটি জায়গায় নয়, পাঠ্যবইয়ে নারী-পুরুষের সমতা, নারী যে কাজ করছে তাকে সম্মান করাটা শিশুদের শেখাতে হবে। ছোট থেকে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে, বড় হলে পরিবর্তন আনা যায় না। রাষ্ট্র ও সমাজ বৈষম্যহীনভাবে গড়ে তুলতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। পাঠ্যবইয়ে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা রোধ করতে হবে, আমরা সেটিই চাই। এই পরিবর্তন উদ্বেগজন, অশনি সংকেত।’

বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ’র সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক বলেন, “তারা নারীকে বৃহত্তর জগৎ ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে গৃহকাজের মধ্যে সীমিত রাখার শিক্ষা দিতে চাচ্ছে। নারীদের জন্য শুধু গৃহের কাজে নিয়োজিত থাকা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হলে তাদের উচ্চশিক্ষারও সুযোগ থাকে না। যে নারীরা

‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে’ যুক্ত হয়েছিলেন তারা এমন শিক্ষায় আবদ্ধ থাকলে রাজপথে মিছিলে যাওয়ার সুযোগ পেতেন না। পাঠ্যবইয়ের এরকম পরিবর্তন অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং উদ্বেগজনক। যারা নারী স্বাধীনতার বিরোধী তারাই কেবল এমন বই লিখতে পারে। এগুলো দেশকে তালেবানিকরণ প্রকল্পের অংশ। আমরা আমাদের সন্তানদের উন্নত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই। তারা যেন জীবন-কর্মের সর্বত্র সমভাবে অবদান রাখতে পারে এমন শিক্ষায় ও মানসিক শক্তিতে গড়ে তুলতে চাই।’

পাঠ্যবই পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের সুপারিশে বই সংশোধন করা হয়েছে। এটি তাদেরই এখতিয়ার। এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন।’

এবার পাঠ্যবই পরিমার্জনের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তাদের একজন লেখক রাখাল রাহা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশে আসছি।’ তিনি রাতে ফোন করার কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘আমি একজন রোগী নিয়ে হাসপাতালে, কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’

২০২৪ সালে যে পরিবর্তন আনা হয়

২০২৪ সালের দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ের কথোপকথনটির সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে ধরা হলো-

মা: তুলি, এদিকে এসো তো।

তুলি: আসছি, মা। 

মা: আজ অনেক কাজ করতে হবে।

তুলি: কী কাজ, মা?

মা: ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। কাপড় গোছাতে হবে।

তপু: আমিও কাজ করবো।

বাবা: আজ তো বাজারেও যেতে হবে।

তুলি: আমি তাহলে বাজারে যাই।

তপু: আমি তবে মার সাথে কাজ করি।

বাবা: কী করবে?

তপু: ঘর পরিষ্কার করবো। কাপড় গোছাবো।

মা: ঠিক আছে। সবাই মিলে কাজ করবো।

বাবা: মিলেমিশে করলে কাজ সহজ হয়।

২০২৫ সালে যে পরিমার্জন আনা হয়েছে

মা: আজ অনেক কাজ করতে হবে।

তুলি: কী কাজ, মা?

মা: ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। কাপড় গোছাতে হবে।

তপু: আমিও কাজ করবো।

বাবা: আজ তো বাজারেও যেতে হবে।

তপু: আমি তাহলে বাবার সাথে বাজারে যাই।

তুলি: আমি তবে মার সাথে কাজ করি।

বাবা: কী করবে?

তুলি: ঘর পরিষ্কার করবো। কাপড় গোছাবো।

মা: ঠিক আছে। সবাই মিলে কাজ করবো।

বাবা: মিলেমিশে করলে কাজ সহজ হয়।

গল্পের তিনটি জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০২৪ সালের বইয়ের গল্পে ‘ঘরবাড়ি পরিষ্কার করবো’ এবং ‘কাপড় গোছাবো’ এই উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তপু নামের এক ছেলে শিক্ষার্থীর বয়ানে। কিন্তু ২০২৫ সালের পরিমার্জিত পাঠ্যবইয়ের গল্পের তপুর জায়গায় ‘ঘরবাড়ি পরিষ্কার করবো’ এবং ‘কাপড় গোছাবো’ উক্তি দুটি ব্যবহার করা হয়েছে তুলি নামে একজন মেয়ে শিক্ষার্থীর বয়ানে।

এছাড়া ২০২৪ সালের পাঠ্যবইয়ে তুলির বাবা বাজারে যাওয়ার কথা বললে তুলির উক্তি ছিল, ‘আমি তাহলে বাজারে যাই।’ ২০২৫ সালের পাঠ্যবইয়ে এই উক্তিটি ব্যবহার করা হয় তপুর বয়ানে। বাবা বাজারে যাওয়ার কথা বললে তপু বলে, ‘আমি তাহলে বাবার সাথে বাজারে যাই।’

পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

লিঙ্গ সমতা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ঘরবাড়ি পরিষ্কার ও কাপড় গোছানো শুধু নারীর কাজ’ তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে গল্পটিতে পরিবর্তন করা হয়েছে। পুরুষ চরিত্র পরিবর্তন করে উক্তিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে নারী চরিত্র দিয়ে। কাজগুলো শুধু নারীর জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ায় লিঙ্গ সমতা নষ্ট করে শিশুদের লিঙ্গবৈষম্য শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই পরিমার্জন করে ২০২৫ সালের পাঠ্যবই করা হয়। তবে প্রাথমিকে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ পরিমার্জন করে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই হিসেবে এবার ছাপানো হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.