প্রশান্তি ডেক্স ॥ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে। গত বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সোয়া ১১টায় বাড়িটির দেয়াল বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে দেখা যায়। এর আগে, বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার পর থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসার সামনে এসে জড়ো হতে শুরু করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। পরে রাত ৮টার দিকে বাড়িটিতে প্রবেশ করেন তারা। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতার ভিড়ও বাড়তে থাকে। সে সময় বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালানোর পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রবেশমুখে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। পরে রাত ১০টা ৫০ মিনিটে বাড়ির সামনে বুলডোজার আনা হয়।এ সময় উপস্থিত ছাত্রদেরকে ‘জনে জনে খবর দে, মুজিববাদের কবর দে’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘জনে জনে খবর দে, আওয়ামী লীগের কবর দে’ এমন বিভিন্ন ‡¯øvগান দিতে দেখা যায়।

রাত ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে সরেজমিনে দেখা যায়, এক্সকাভেটরটি ঘিরে শত শত জনতা ে¯্লাগান দিচ্ছে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আজকে ছাত্রলীগের ব্যানারে জাতির সামনে ভাষণ দিয়েছে। যে আমাদের ভাইদের গুলি করে দেশ থেকে পালিয়েছে, সে কী করে কর্মসূচি ঘোষণা করে। আমরা এ দেশে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার কোনও অস্তিত্ব রাখবো না।’
‘যারা ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল সেসব ফ্যাসিবাদীদের কোনও চিহ্ন বাংলাদেশের মাটিতে রাখতে চাই না। অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত এনে তার শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
এরআগে, নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল অধিবেশনে যোগদানের ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে গত বুধবার রাত ৯টার দিকে ‘লং মার্চ টু ধানমন্ডি-৩২’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স। এ ছাড়া সন্ধ্যায় ‘ছাত্র-জনতা আন্দোলন’ নামে ফেসবুকে বিভিন্ন পেজে কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে পোস্ট করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পাশাপাশি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ খবর পাওয়ার পরপরই বিকালে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল উত্তেজিত জনতা।
বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হানিফের বাড়ি :
কুষ্টিয়ায় বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়ি। গত বুধবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টার দিকে শহরের পিটিআই সড়কে তিনতলা বাড়িটি ভাঙা শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে নেতাকর্মীরা।
এর আগে গত ৪ আগস্ট ও ৫ আগস্ট এই বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চলেছিল লুটপাট। এ ঘটনার পর বাড়িটিতে ইট ছাড়া কিছুই ছিল না। তবে ৫ আগস্ট থেকে হানিফ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, তিনি ভারতে পালিয়ে আছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একটি বুলডোজার নিয়ে প্রথমে বাড়ির প্রধান ফটক ও সীমানাপ্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ছাত্ররা ে¯্লাগান দিতে থাকেন ‘স্বৈরাচারের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’। এ সময় বাড়ির সামনে অনেকেই ভিড় করেন।
এর আগে রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলা মোড় থেকে একটি মশাল মিছিল নিয়ে হানিফের বাড়ির সামনে আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে নেতাকর্মীরা। রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত হানিফের বাড়িতে ভাঙচুর চালান বিক্ষুব্ধরা। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খানের শহরের কদমতলা সাততলা বাড়ির দিকে যায় মিছিল। সেখানে রাত পৌনে ১১টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় ওই বাড়িতে ভাঙচুর চালাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।
অনেকে ে¯্লাগানে বলতে দেখা যায়, কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকায় হানিফের চাচাতো ভাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের সাততলা ভাঙা বাড়িতেও বুলডোজার দিয়ে আবার ভাঙা হবে। সেজন্য এই বাড়িতেও বুলডোজার আনা হচ্ছে।
খুলনায় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘শেখ বাড়ি’ :
খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় অবস্থিত আলোচিত ‘শেখ বাড়িতে’ ভাঙচুর চালিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। পরে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এটি। বাড়িটি বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ময়লাপোতা এলাকার বাড়িটি ঘিরে ফেলেন হাজারো শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় লোকজন। রাত ৯টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ঘোষণা দিয়ে বাড়িতে ভাঙচুর চালান। পরে তারা সিটি করপোরেশনের দুটি বুলডোজার নিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু করেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ে¯্লাগান দেন। অনেকে রড-হাতুড়ি দিয়ে বাড়ির প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা করেন। রাত সোয়া ৯টার দিকে বাড়ির ছাদে কিছু সময় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তবে এ সময়ে বাড়ির আশপাশে কোথাও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আহসান হাবিব বলেন, ‘ভাঙচুরের ঘটনাটি আমি ফেসবুকে দেখেছি। এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। খোঁজখবর নিচ্ছি।’
শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় অবস্থিত ওই বাড়িটি খুলনায় ‘শেখ বাড়ি’ নামে পরিচিত। এই বাড়িতে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ সোহেল উদ্দিনসহ আরও কয়েক ভাই থাকতেন। ওই বাড়ি থেকেই মূলত পদ্মার এপারের আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো। গত ৪ আগস্ট প্রথম দফায় বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন ছাত্ররা। সেদিন বাড়িতে কেউ ছিলেন না। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। এরপর বাড়িটিতে শুধু ইটপাথরের কাঠামোই অবশিষ্ট ছিল।
শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরে ভাঙচুর–আগুন :
রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর চালায় একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র। গত বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ে¯্লাগান ে¯্লাগানে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে জড়ো হতে থাকে শত শত ছাত্র। পরে তারা ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে হামলা করে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেওয়া চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে তারা ৩২ নম্বর বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। এরপর রাত ১০টার দিকে তারা মুজিবের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, এই বাড়ি থেকে ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি শুরু হয়েছে। তাই দেশের মাটি থেকে এই বাড়ি মুছে ফেলতে চায় দেশের জনগণ। বিশেষ করে গত ১৬ বছর শেখ হাসিনা সরকার দেশের মানুষের রক্ত চুষে আবার দেশের মানুষকে মারার পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইসমাইল হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা জুলাই আন্দোলনে দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। এই খুনি হাসিনা আবারও ষড়যন্ত্র করার পরিকল্পনা করছে। তাছাড়া আজকে স্বৈরাচার সরকার পতনের অর্ধবছর পূর্ণ হয়েছে। এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টে বলা হয়, ‘‘ধানমন্ডি-৩২ অভিমুখে ‘লং মার্চ টু ধানমন্ডি-৩২’ বুলডোজার মিছিল। হাজারো ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই খুনি হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার প্রতিবাদে ২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উদ্যোগে আজ রাত ৯টায় এ কর্মসূচি পালিত হবে।’’
এর আগে গত মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানানো হয়, ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টায় ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। এর প্রতিবাদে গত বুধবার রাত ৯টায় ‘লং মার্চ টু ধানমন্ডি-৩২’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে ছাত্ররা। তবে তাদের পূর্ব ঘোষিত ঘোষণার আগেই ভাঙচুর শুরু করা হয়।
এদিকে যেকোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগে থেকেই ধানমন্ডি-৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের আশপাশের এলাকায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। তবে ৩২ নম্বর বাড়িটি ভাঙচুর করার সময় বাড়ির সামনে তিনটি পুলিশের গাড়ি ও বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। পরে শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর চালানোর সময় পুলিশ ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও কেউ রিসিভ করেননি।
বাধার মুখে সরে গেলেন সেনা সদস্যরা
রাত সোয়া ৯টার দিকে একদল সেনা সদস্য পুনরায় ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ির গেটের সামনে পর্যন্ত চলে আসেন। তবে ছাত্রদের বাধার মুখে তারা সেখান থেকে চলে যান। এ সময় ছাত্রদের ভেতর থেকে ভুয়া ভুয়া বলে ে¯্লাগান দিতেও শোনা যায়।
৩২ নম্বরে এস্কাভেটর (ভেকু) এদিকে রাত ১০টা ৫০ মিনিটে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে একটি এস্কাভেটর (ভেকু) আনা হয়েছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের একটি অংশ এই ভেকু এনেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।