প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর শান্তি আলোচনায় অংশগ্রহণের দাবি জানিয়েছে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ইউক্রেন নিজের সব অঞ্চল ফিরে পাবে না এবং ন্যাটোতে যোগদান করতে পারবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ এই যুদ্ধ শিগগিরই চতুর্থ বছরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ট্রাম্প-পুতিনের এই আলোচনার সম্ভাবনায় রাশিয়ার আর্থিক বাজার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইউক্রেনের ঋণের মূল্যও বেড়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।

তবে ট্রাম্পের একতরফা এই উদ্যোগ এবং ইউক্রেনের প্রধান দাবিগুলোতে ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত কিয়েভ ও ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তারা আশঙ্কা করছেন, হোয়াইট হাউজ তাদের বাদ দিয়ে চুক্তি করতে পারে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, আমরা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের ছাড়া কোনও চুক্তি মেনে নেবো না।
তিনি আরও বলেন, পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করতে চাইছেন এবং সেটি হতে দেওয়া যাবে না।
ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ট্রাম্পের শান্তি উদ্যোগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলেছেন, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্রদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনও চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা কাল্লাস বলেছেন, যেকোনও দ্রুত সমাধান একটি নোংরা চুক্তিতে হবে। তিনি ট্রাম্পের পূর্বানুমোদিত ছাড়ের সমালোচনা করে বলেন, আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই কেন আমরা রাশিয়াকে তারা যা চায় সব দিচ্ছি? এটি প্রশ্রয় দেওয়ার মতো, যা কখনও কাজ করেনি।
এক ইউরোপীয় কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার শুরু হতে যাওয়া বার্ষিক মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্পষ্ট ও দাবিপূর্ণ আলোচনা করতে মন্ত্রীরা সম্মত হয়েছেন।
ট্রাম্প ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পর প্রথমবারের মতো পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন এবং এরপর জেলেনস্কিকেও ফোন করেন। তিনি বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে উভয় নেতাই শান্তি চান।
তবে ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যেই বলেছে যে, ইউক্রেনের পক্ষে ২০১৪ সালের সীমানায় ফিরে যাওয়া বা ন্যাটোতে যোগদান করা অবাস্তব। এছাড়া যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে ইউক্রেনে কোনও নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা হলে তাতে মার্কিন সেনারা অংশ নেবে না। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, বিশ্ব সৌভাগ্যবান যে ট্রাম্পের মতো পৃথিবীর সেরা আলোচক দুই পক্ষকে একত্রিত করে শান্তি আলোচনা করাচ্ছেন।
ক্রেমলিন বলেছে, তারা ট্রাম্পের অবস্থানে প্রভাবিত হয়েছে এবং তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের সঙ্গে এর তীব্র পার্থক্য রয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, গতকালের আলোচনায় একটি রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রকাশ পেয়েছে, যা সংকট নিরসনের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে এবং পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। ২০২২ সালের পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পর রাশিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের আরও কিছু অঞ্চল দখল করে। ইউক্রেন ২০২২ সালে রাশিয়ার সেনাদের কিয়েভের উপকণ্ঠ থেকে পিছু হটাতে সক্ষম হয় এবং কিছু অঞ্চল পুনর্দখল করে। তবে ২০২৩ সালে ইউক্রেনের ব্যর্থ পাল্টা আক্রমণের পর থেকে ধীরে ধীরে আরও অঞ্চল রাশিয়ার দখলে চলে যাচ্ছে।
এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার সেনা নিহত ও আহত হয়েছে এবং ইউক্রেনের শহরগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের এই দীর্ঘ সময়ে উভয় পক্ষের অবস্থানে কোনও পরিবর্তন আসেনি। মস্কো চাচ্ছে যে ইউক্রেন আরও অঞ্চল ছেড়ে দিক এবং শান্তি চুক্তিতে স্থায়ীভাবে নিরপেক্ষ থাকুক। অন্যদিকে, কিয়েভ বলছে যে রাশিয়ার সেনাদের অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে এবং ভবিষ্যত হামলা প্রতিরোধে ন্যাটো সদস্যপদের সমতুল্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পেতে হবে।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা আগেই স্বীকার করেছেন যে, স্বল্পমেয়াদে ন্যাটো সদস্যপদ অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে এবং একটি শান্তি চুক্তিতে কিছু দখলকৃত অঞ্চল রাশিয়ার হাতে থাকতে পারে। তবে ট্রাম্পের পূর্বানুমোদিত ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে আলোচনা শুরু করায় কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা উদ্বিগ্ন।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই সিবিহা বলেছেন, ন্যাটোতে যোগদানের জন্য ইউক্রেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে, যা শান্তি নিশ্চিত করতে পশ্চিমা দেশগুলোর সবচেয়ে সহজ ও কম ব্যয়বহুল উপায়।
কিয়েভের বাসিন্দা মিরো¯্লাভা লেসকো বলেছেন, এটি সত্যিই মনে হচ্ছে যে তারা ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণ করাতে চাইছে, কারণ এই আলোচনা বা ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে আমাদের দেশের জন্য কোনও সুবিধা দেখছি না। তবে তিন বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনীয়রা ক্লান্ত এবং অনেকেই শান্তি অর্জনের জন্য কিছু লক্ষ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রেসিডেন্ট টিমোফি মিলোভানভ বলেছেন, বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে পার্থক্য হলো, ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলছেন যা বাইডেন ভাবতেন এবং ইউক্রেন সম্পর্কে করতেন।