প্রশান্তি ডেক্স ॥ অমর একুশে বইমেলায় সব্যসাচী প্রকাশনীর স্টলে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বই রাখার অভিযোগে গতকাল একদল বিক্ষুব্ধ লোকের রোষানলে পড়েন শতাব্দী ভব নামে এক লেখক। পরে পুলিশের সাহায্যে মেলা থেকে বের করে নেওয়া হয় তাকে। এ সময় প্রকাশ্যে লেখককে ক্ষমা চাইতে হয়। এর পরপরই সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয় স্টলটি। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমি স্টলটি খুলে দেওয়ার কথা জানালেও আজ বিকালে সেই স্টল বন্ধ থাকতে দেখা যায়। বইমেলার এই ঘটনায় নানা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে। যদিও প্রকাশকরা বলছেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের কথা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বই বিক্রি করা দেখে সব্যসাচীর স্টলে ভিড় করে একদল লোক। লেখক শতাব্দী তখন সেখানেই বসেছিলেন। তসলিমা নাসরিনের বই কেন বিক্রি করছেন প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে শুরু হয় বাগবিতণ্ডা। একপর্যায়ে শতাব্দী ‘জয় বাংলা’ ে¯্লাগান দিলে উত্তেজিত লোকজন তাকে মারতে যায়। এ সময় তাকে কানে ধরে ক্ষমা চাওয়ার দাবিও ওঠে। একপর্যায়ে এই লেখক হাতজোড় করেন এবং পুলিশ তাকে নিয়ে চলে যায়।তবে এ ঘটনার আগে থেকেই স্টলে তসলিমা নাসরিনের বই রাখার কারণে সব্যসাচী প্রকাশনীকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ করেছেন সব্যসাচীর প্রকাশক মেহরান সানজানা। এ বিষয়ে ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে তিনি লিখেন, “বাংলা একাডেমির মেলার মাঠের দায়িত্বে যিনি আছেন, আমাকে কল দিয়ে বললেন তসলিমা নাসরিনের বই সরিয়ে ফেলতে। শাহবাগ থানার ওসিও একই কথা বললেন। বাধ্য হয়ে সরাতে হচ্ছে তসলিমা নাসরিনের ‘চুম্বন’ বইটি।”এই ঘটনার পর পর উত্তেজনার মুখে স্টলটি বন্ধ করে দেয় পুলিশ। যদিও বাংলা একাডেমির বইমেলা টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক ড. সেলিম রেজা জানান, যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে সব্যসাচী স্টলটি বন্ধ করা হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। স্টলটি কিছুক্ষণ বন্ধ রাখার পর এখন খোলা হয়েছে। বইমেলা কমিটি ও সেখানে উপস্থিত থাকা আমাদের টাস্কফোর্সের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে এ ধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত।

এদিকে গত মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৩টা থেকে মেলা শুরু হলে সেখানে গিয়ে বন্ধ পাওয়া যায় স্টলটি। এই বিষয়ে ড. সেলিম রেজা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে স্টল বন্ধ রেখেছে পুলিশ। গতকালকের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্টলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’এদিকে বইমেলার এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশকরা কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন।আদর্শ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গতকালকের বইমেলার ঘটনাটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানাই।’
তার সঙ্গে একমত পোষণ করে পুথিনিলয় প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল বলেন, ‘মত থাকতেই পারে। তাই বলে । ভালোভাবে বলা যায়, এই বইটি তুলবেন না। বলার মতো কিন্তু মেলায় একটি যথাযথ চ্যানেল আছে, কমিটি আছে, টাস্কফোর্স আছে। সেখানে বাংলা একাডেমির সদস্য, প্রকাশক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আছেন। বই নিয়ে এখানে অভিযোগ করা যায়। কিন্তু স্বেচ্ছায় গিয়ে একটা স্টল বন্ধ করে দেওয়া, যা খুশি করা, অন্যায় হলেও সেটা থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যথাযথ জায়গায় অভিযোগ না করে যদি স্বেচ্ছায় কিছু করতে যাওয়া হয় তাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। বইমেলা কিন্তু একটা দেশের ভাবমূর্তি। একজন প্রকাশক সাহস করে ফেসবুকে বলছেন আইনের আওতায় আনার কথা, এটা সবাই এভাবে বলবেন না।’
কেউ কেউ ভাবছেন নিরাপত্তা নিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকাশক বলেন, ‘বই নিয়ে ঘোষণা দিয়ে মেলায় এসে জবাবদিহি করা আসলেই উদ্বেগের বিষয়। গতকাল একটি বই নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এক গ্রুপ এসেছে, কাল আরেক গ্রুপ আসবে অন্য কারও বইয়ের বিষয়ে, এভাবে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই কি চলবে? বই নিয়ে আপত্তি থাকলে মেলা কমিটিকে জানানো হোক। সরাসরি মেলায় এসে স্টলের সামনে আপত্তি জানানোর এরকম সংস্কৃতি চলতে থাকলে বইপ্রেমীরা মেলাবিমুখ হবেন।’
এদিকে গতকালকের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েজন বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘সরকার জননিরাপত্তা দিতে, বিশেষ করে সব মানুষের ধর্মীয় ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে। এর ফলে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি বিশ্বে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের কবলে যাওয়া দেশ এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে চরমভাবে ব্যর্থ সরকার হিসেবে দেখাতে পারছে। এভাবেই তারা দেশে ও বিদেশে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারছে।’
এদিকে, বইমেলার বাগবিতণ্ডা-হট্টগোলের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ধরনের বিশৃঙ্খল আচরণ বাংলাদেশে নাগরিকের অধিকার এবং দেশের আইন উভয়ের প্রতিই অবজ্ঞা প্রদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।