‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

প্রশান্তি ডেক্স ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি ঢাকায় আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। বিশাল ব্যয়ের এই বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পটির বাস্তবায়নে কোনও অগ্রগতি নেই, শুধু সমীক্ষাতেই সময়ক্ষেপণ হয়েছে। আর এই সমীক্ষাতে ব্যয় হয়েছে রাষ্ট্রের ১৩৬ কোটি টাকা। কাজ শুরু না করে বছরের পর বছর কালক্ষেপণ করায় এর নির্মাণব্যয়ও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আর এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ আসলে কী, তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রাজধানীর কাছাকাছি কোথাও আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা নেয়। মূলত ঢাকাকে আকাশ যোগাযোগের সংযোগস্থল বা ‘হাব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নতুন বিমানবন্দরের নাম প্রস্তাব করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’।

২০১০ সালে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রাথমিক ব্যয় ধরে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। প্রকল্প প্রস্তাবনায় এ বিমানবন্দরে তিনটি রানওয়েতে প্রতিদিন যাত্রীবাহী ৪০০টি ও কার্গোবাহী ২০০টি ফ্লাইট ওঠানামার সুযোগ রাখা হয়েছিল। বিমানবন্দর নির্মাণের উপযুক্ত জায়গা হিসেবে সরকারের প্রাথমিক বাছাইয়ে উঠে আসে মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিল ও ময়মনসিংহের ত্রিশালের নাম। পরে ত্রিশালকে বাদ দিয়ে আড়িয়াল বিলেই বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা করে সরকার।

মন্ত্রিসভায় প্রকল্প অনুমোদনের এক বছর পর ২০১১ সালে আড়িয়াল বিলে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জমি অধিগ্রহণের কাজ। কিন্তু শুরুতেই স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়ে এ প্রকল্প। আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে জনতা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সেই সংঘর্ষে স্থানীয় জনতার পাশাপাশি, পুলিশ ও সাংবাদিকসহ কয়েকশ মানুষ আহত হয়। এর পরই নতুন করে বিমানবন্দর নির্মাণের প্রকল্প থমকে যায়।

আন্দোলনের মুখে আড়িয়াল বিলে জমি অধিগ্রহণের কাজ স্থগিত করা হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, বিমানবন্দর হবে পদ্মার ওপারে, মাদারীপুর কিংবা শরীয়তপুরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে বিমানবন্দর প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়িকে। ৪ বছর সমীক্ষার পর মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের সীমান্ত ঘেঁষে উপযুক্ত স্থান বেছে নেয় তারা।

প্রতিষ্ঠানটি বিমানবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্য ২৮টি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে ১০টি স্থান প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করে। পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত আরও অন্যান্য প্যারামিটার বিবেচনায় তিনটি উপযুক্ত সম্ভাব্য স্থান থেকে দুটি স্থানকে নির্বাচন করা হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীকে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে, মাস্টার প্ল্যান, এয়াররুট, অ্যারোস্পেস, এয়ার ট্রাফিক ফোরকাস্ট ও উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পন্ন করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের কোনও নির্দেশনা পাওয়া না গেলেও ভবিষ্যতে সরকারি নির্দেশনার আলোকে যেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সে আলোকেই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পার হয়ে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সীমান্ত ঘেঁষে এই বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছিল। সাবে্‌ক প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সংকেত পেলেই কাজ শুরু হতো। এছাড়া যানজট থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে ঢাকা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং বিমানবন্দরটি চালুর ৮ বছরের মধ্যে যাত্রীর চাপ সামলাতে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সব পরিকল্পনাই ছিল। সেসময় চাইলে প্রকল্পটির কাজও শুরু করা যেতো। কিন্তু তা না করে পিডিসহ অনেকেই নানান টালবাহানা করেছেন। আর কালক্ষেপণ করে এই প্রকল্পটির ব্যয় এখন দ্বিগুণ করা হয়েছে। আর প্রকল্প শুরু না হলেও শুধু সমীক্ষাতেই ১৩৬ কোটি টাকা খরচ করে ফেলা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, এই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ছিলেন বর্তমান বেবিচকের আলোচিত প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান, যিনি দুদকের ৪ মামলার আসামি।

বর্তমানে এই প্রকল্পের ভবিষ্যতে কী, তা বলতে পারেন না কেউ। আদৌ এই বিমানবন্দর নির্মাণ হবে কিনা, তাও কেউ জানেন না। খোদ বেবিচকের কর্মকর্তারাই বলছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।

প্রকল্পের বিষয়ে কিছু জানাতে না পারলেও সমীক্ষা ব্যয়কে ‘অপচয়’ মনে করছেন না বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটির সমীক্ষা শেষ করে দুটি জায়গা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই সমীক্ষা প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ, ভবিষ্যতে দেশের কাজে লাগবে।’

তিনি আশার কথা শুনিয়ে বলেন, ‘একটা সময় তো আমাদের এই (শাহজালাল) বিমানবন্দর চাপ সামলাতে পারবে না। তখন প্রয়োজন হবে।’

সমীক্ষায় অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে সময় আমি ছিলাম না। ব্যয় বেশি ধরা হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.