প্রশান্তি বিশেষ প্রতিবেদন ॥ মার্কিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুসারে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট- আইআরআই ২০১৮ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। বিএনপিকে দিয়ে কাজ হবে না বুঝতে পেরে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শিল্পীসমাজ এমনকি এলজিটিবিটিকিউদেরও ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বহু বছরের প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে দেশটির একটি অনলাইন সংবাদপত্র। বেশ কিছু গোপন নথি তারা তুলে ধরেছে, যাতে দেখা যায় ২০১৮ সাল থেকেই এই চেষ্টা শুরু করে দেশটির সরকার।
দ্য গ্রে জোন নামে সেই সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে হটানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রর সরকারের অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) একটি বিশাল কর্মী বাহিনী প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, যার মধ্যে র্যাপার এবং এলজিবিটিকিউআইসহ বিভিন্ন শ্রেণির কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘ক্ষমতার পরিবর্তন’-এর বিষয়টি মাথায় রেখে তারা ‘হিজড়াদের নাচের পারফরম্যান্স’ এর মত কর্মসূচিরও আয়োজন করে।
আইআরআই বাংলাদেশের রাজনীতিকে ক্রমাগত অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করেছে এবং সেই মিশন সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে।
এসব নথিপত্র অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রথম পছন্দ ছিল বিএনপি। তবে তারা বুঝতে পেরেছে দলটির জনসমর্থন তেমন ছিল না, তারা যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সংশয়ে ভোগে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ছিল শক্তিশালী অবস্থানে। পরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। তারা তরুণদের বেছে নেয়, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের মাঝে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। সেই সঙ্গে সরকারবিরোধী জনমত গঠনে শিল্পীদেরও ব্যবহার করে।
সাংবাদিক ম্যাক্স ব্লুমেনথাল এই সংবাদমাধ্যমটির প্রতিষ্ঠাতা। এটি প্রথমে ‘দ্য গ্রে জোন প্রজেক্ট’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৮ সালের পর থেকে এটি স্বাধীনভাবে কার্যক্রম শুরু করে।
নিউজ ওয়েবসাইটটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রর পররাষ্ট্রনীতির কট্টর সমালোচক। পাশাপাশি, যেসব রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে করুণ পরিণতির শিকার বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কারণে যুদ্ধবিগ্রহের ভিক্টিম, সেসব দেশের পক্ষে মানবিক অবস্থান নেওয়ার কারণেও সংবাদমাধ্যমটি পরিচিত।
ম্যাক্স ব্লুমেনথাল একইসঙ্গে সাংবাদিক, লেখক, ব্লগার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। দ্য ন্যাশন, অল্টারনেট, দ্য ডেইলি বিস্ট, আল আখবার নামে বইও লিখেছেন তিনি। কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেছেন আল-জাজিরা ইংলিশ, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে। এছাড়া, রাশিয়ার স্পুৎনিক ও রাশিয়া টুডেতেও কাজ করেছেন তিনি।
তার প্রতিবেদনে লেখা হয়: টানা কয়েকমাসের অব্যাহত প্রচেষ্টা, সহিংসতা ও বিক্ষোভের পর অবশেষে ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হটানো সম্ভব হয়। যখন সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং তথাকথিত ‘অর্ন্তবর্তী প্রশাসন’ চালুর ঘোষণা দেয়, তখন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় হাসিনাকে প্রাণরক্ষায় হেলিকপ্টারযোগে ভারতে যেতে।
বিশাল সংখ্যক ছাত্র বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়ার পর পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং তাদের অনেক প্রগতিশীল সমর্থক এই বিদ্রোহকে স্বাগত জানায়। একে তারা ‘ফ্যাসিবাদের’ পরাজয় এবং গণতান্ত্রিক শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হিসেবে তুলে ধরে।
শেখ হাসিনার স্থলাভিষিক্ত হওয়া ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রর সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’-এর সদস্য এবং তিনি ক্ষুদ্র ঋণের প্রয়োগের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ইউনূস নিজেই সেই বিক্ষোভ আন্দোলনকে ‘সুপরিকল্পিত’ (মেটিক্যুলাসলি ডিজাইনড প্ল্যান) বলে এর কুশীলবদের পরিচয় করে দিয়ে প্রশংসাও করেছেন।
ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে একটি বার্তা প্রচার হয়, যাতে বলা হয়েছে, তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশের ভূখন্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই অভিযোগকে অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছে।
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেছেন, “শেখ হাসিনার পদত্যাগে যুক্তরাষ্ট্রর কোনো ভূমিকা ছিল এমন কোনো অভিযোগই সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
তবে দ্য গ্রে জোন পর্যালোচিত ফাঁস হওয়া নথিগুলি নিশ্চিত করেছে, আইআরআই বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘অস্থিতিশীল’ করার একটি স্পষ্ট মিশন নিয়ে কাজ করেছিল। তাদের সেই লক্ষ্য এবং কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রর পররাষ্ট্র দপ্তরকে নিয়মিত অবহিতও করা হয়েছিল। সেই নথিগুলি “গোপনীয় এবং/অথবা সংরক্ষিত” হিসাবে চিহ্নিত ছিল।
আইআরআই হল রিপাবলিকান পার্টি পরিচালিত ন্যাশনাল এনডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির (এনইডি) অধীনস্ত একটি প্রতিষ্ঠান, যা গত ৪০ বছর ধরে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-সিআইএ’র অধীনে কাজ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ক্ষমতা পরিবর্তনে কাজ করে এই সংস্থাটি।
ফাঁস হওয়া নথিগুলো থেকে জানা যায়, আইআরআই শেখ হাসিনাকে অপসারণের আগে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা খরচ করে বিরোধীদলগুলোকে গোপনে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। পরে দেশের তরুণ যুবসমাজের মধ্যে সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে একটি গোপন নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল।
রিপাবলিকান পার্টি পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি যাদের অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে র্যাপার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা এবং মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ‘হিজড়াদের নাচের পারফরম্যান্স’ আয়োজনকারী এলজিবিটি কর্মীরাও ছিল।
মিশন শুরু ২০১৮ সালে
যে বিক্ষোভগুলো শেখ হাসিনার সরকারকে হটানোর জন্য দায়ী, তার সূত্রপাত ২০১৮ সালে। সে সময়, এক বাসচালক দুই স্কুল শিক্ষার্থীকে চাপা দিলে হাজার হাজার তরুণ ঢাকার রাস্তায় নামে নিরাপদ সড়কের দাবিতে। সেই বিক্ষোভ শেখ হাসিনার সরকারকে অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইন করতে বাধ্য করে।
সে সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে পুঁজি করে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে রাজপথে বিক্ষোভ করেছে, যা প্রায়ই সংঘাতে পরিণত হতো। বিক্ষোভকারী এবং শেখ হাসিনার সরকারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই লড়াই গত ৫ই আগস্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, যখন সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে। ক্যু-এর পর, বিশ্লেষকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকার দিকে আঙুল তুলেছেন, যা সরকারবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলে এবং ঢাকার রাজপথে অস্থিরতা তৈরি করে।
কাকতালীয়ভাবে, সম্প্রতি ফাঁস হওয়া আইআরআই-এর নথিগুলোতেও দেখা যায়, রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ঘটাতে তারা অনলাইন প্রশিক্ষণ এবং গোপন যোগাযোগের সুরক্ষার গুরুত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
আইআরআই সব সময় শেখ হাসিনাকে হটাতে চেয়েছে
আইআরআই ২০০৩ সাল থেকে ঢাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। নথি থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, আইআরআই এনজিও, কর্মী গোষ্ঠী, রাজনীতিবিদ, এমনকি সঙ্গীত ও ভিজ্যুয়াল শিল্পীদের নিয়ে একটি ছদ্ম রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলে, যা বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করতে ব্যবহার করা যায়। ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলন এবং একই বছরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের বিপুল নির্বাচনী বিজয়ের পর ক্ষমতার পট-পরিবর্তনে আইআরআই-এর উদ্যোগ আরও জোরদার হয়।
২০১৯ সালে, সংস্থাটি একটি গবেষণা শুরু করে। যার মধ্যে ছিল ৪৮টি গ্রুপ ডিসকাশন এবং ১৩টি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়, যেখানে ৩০৪ জন তথ্য সরবরাহকারী ছিলেন।
গবেষণার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রর পররাষ্ট্র দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। আইআরআই-এর কর্মীরা ১৭০ জনেরও বেশি ‘গণতন্ত্রকামী’ কর্মীকে বাছাই করে যারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করতে সংস্থাটিকে সহযোগিতা করেছে।
আইআরআই তখন সিদ্ধান্ত নেয়, বিএনপি তাদের সমর্থকদের সফলভাবে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, দলটির ‘রাজপথের আন্দোলন উসকে দেওয়ার চেষ্টা’ ভেস্তে গেছে এবং তাদের রাজনৈতিক সক্ষমতা ক্ষুদ্র সংগঠনের মতো প্রমাণ হয়েছে। তবুও আইআরআই বিএনপিকেই ‘ভবিষ্যতে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোর সবচেয়ে সম্ভাব্য দল’ বলে বিবেচনা করেছিল।
তবে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ব্যালটের মাধ্যমে সম্ভব হবে, এ সম্ভাবনা সবসময় ছিল ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্রর মতে, বিএনপি অত্যন্ত সহিংস একটি দল, একইসাথে গোঁড়া, অন্তর্মুখী, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় তাদের নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা ছিল না। তাই আইআরআই এমন একটি পরিকল্পনা নেয়, যা নাগরিক কেন্দ্রিক, স্থানীয় ও অপ্রচলিত রাজনৈতিক মতাদর্শী (বাম) দলগুলোর সমন্বয়ে তৈরি করে আরও প্রসারিত করা হবে। অর্থাৎ, এই গোষ্ঠীগুলোকে সম্পৃক্ত করে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে পট-পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়।
আইআরআই-এর রাজপথে বিক্ষোভ এবং অনলাইনে গোপন যোগাযোগের প্রতি আগ্রহের অনেক কিছুই বিস্তারিতভাবে একটি আলাদা অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর শিরোনাম ছিল “বাংলাদেশের ডিজিটাল যুগে সামাজিক মাধ্যম, প্রতিবাদ এবং সংস্কার”।
যেখানে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আবারও দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা এমন একটি হাতিয়ার ব্যবহার করেছে, যা তাদের পূর্বসূরিদের হাতে ছিল না, আর তা হল ইন্টারনেট। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “আইআরআই ভবিষ্যতে দেশের কলেজ-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।”
নথিতে ব্যাখ্যা করা হয়, বাংলাদেশি বিক্ষোভকারীরা সফলভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ভিডিও এবং তাদের কর্মকান্ডের সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করেছে। পরে তা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে আন্দোলনের কভারেজ দিতে বাধ্য করেছে।
আইআরআই কর্মীরা উল্লেখ করেছে, তারা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে যেন বাংলাদেশের যুবসমাজ অনলাইন এবং অফলাইন পরিবর্তনের হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করার জন্য জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করে। আইআরআই সামাজিকভাবে সচেতন কয়েকজন শিল্পীকে সমর্থন করেছিল, যাদের তারা ক্ষমতা পরিবর্তনের কাজে একটি গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করে।
আইআরআই উল্লেখ করেছে, “যখন প্রচলিত নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলো ক্রমাগত চাপের মুখে থাকে, তখন একক (সলো) শিল্পী ও কর্মীদের দমন করা কঠিন হয় এবং তারা প্রায়শই তাদের গণতান্ত্রিক ও সংস্কারমূলক বার্তাগুলো দিয়ে বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে।” তবে ওয়াশিংটনের এই মিশন কেবল সলো শিল্পীদের ওপরেই নির্ভরশীল ছিল না।
আইআরআই আরও লিখেছিল, তারা তিনটি ‘প্রান্তিক সম্প্রদায়’ চিহ্নিত করেছে, যারা বিতর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে “ধাক্কা দেওয়ার” কাজটি করবে। এরা হলো: বিহারি (বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্থানি অংশ), সমতলভূমির সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং এলজিবিটিআই গোষ্ঠী।
২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, আইআরআই অভিনয় শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পী, পারফর্মার বা সংগঠনগুলোকে মোট ১১টি অ্যাডভোকেসি অনুদান দিয়েছিল। তারা রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়াবলি নিয়ে ২২৫টি শিল্পকর্ম তৈরি করে। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে, আইআরআই দেশে তিনটি ‘হিজড়া নৃত্য প্রদর্শনী’র আয়োজন করেছিল।
প্রতিবেদন অনুসারে, “এসব পারফরম্যান্সের লক্ষ্য ছিল হিজড়া সম্প্রদায়ের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় সম্প্রদায় ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে হিজড়াদের বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।”
ঢাকায় অনুষ্ঠিত শেষ পারফরম্যান্সে, মার্কিন দূতাবাস তাদের ডেপুটি কনসাল জেনারেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে থাকা বাংলাদেশি র্যাপাররাও অংশ নেয়।
এ বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশি গণমাধ্যমে কাজ করা একজন ব্যারিস্টার ও শিল্পী আন্দোলকারীদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবও দেন।
আইআরআই-এর নথিপত্রে প্রকাশ পায়, সেই ব্যারিস্টার ও শিল্পীকে মার্কিন সরকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। সংস্থাটির নথি অনুযায়ী, ‘আইআরআই-এর ক্ষুদ্র অনুদান প্রোগ্রামের’ অধীনে ২০২০ সালে দুটি মিউজিক ভিডিওর মধ্যে ‘তুই পারিস’ নামের গানটি প্রথমটি মুক্তি দেন। গানটি স্পষ্টভাবে যুবসমাজকে উস্কে দেয় এবং তাদেরকে সরকার হটাতে যে কোনো উপায়ে বিক্ষোভ এবং রাজপথের আন্দোলনে উৎসাহী করে।
দ্বিতীয় মিউজিক ভিডিওটির গানের কথা ছিল ধর্ষণ, দারিদ্র্য এবং শ্রমিকদের অধিকারসহ বিভিন্ন সামাজিক বিষয়কে ঘিরে। এটি সামাজিক সমস্যাগুলো তুলে ধরে সরকারের প্রতি বিদ্বেষ ও ভিন্নমত তৈরির জন্য নির্মাণ করা হয়, যাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তোলা যায়। ‘রক্তের লালের মধ্যে শক্তি রয়েছে’ নামে একটি হিপ-হপ গানকেও মার্কিন সরকার স্পন্সর করে। এভাবে স্থানীয় হিপ-হপ শিল্পীদের অর্থায়ন করে, আইআরআই একটি মার্কিনপন্থি শিল্পরূপের প্রচার করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এভাবে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র হিসাবে সঙ্গীতকে ব্যবহার করে আসছে।
আইআরআই লিখেছে, বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক কর্মীরা হয়ত সরাসরি রাজনৈতিক রীতি পরিবর্তন এবং প্রাতিষ্ঠানিক আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে না। তবে এটি অবশ্যই রাজনৈতিক বিতর্ককে চাঙ্গা করতে এবং সামাজিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে পারে।
বিএনপি অজনপ্রিয় ও লক্ষ্যহীন একটি দল
আইআরআই-এর অভ্যন্তরীণ নথিপত্রে লেখা হয় যে, বিএনপির জনপ্রিয়তার অভাব, রাজনৈতিক দল হিসেবে অযোগ্যতা বাংলাদেশে নাগরিক সমাজে মার্কিন সরকারের অনুপ্রবেশকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে।
আইআরআই একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বহু মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন ছাড়া বিএনপি ‘সহিংসতা, বয়কট রাজনীতি, অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংশয়ের’ মাঝে আটকে থাকবে এবং ভোটারদের দ্বারা প্রায় সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই তলানিতে।
আইআরআই-এর ২০২০ সালের চূড়ান্ত রিপোর্টটি আরও স্পষ্টভাবে বলে, বিএনপি ‘সফলভাবে জনগণকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ তারা ২০১৪-তে নির্বাচন বয়কট করেছিল, যা নিয়ে সমালোচিত হয় দলটি। ২০১৮-তে নির্বাচন বয়কটের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে তাতে অংশগ্রহণ করলেও কৌশলটি কোনোভাবেই কাজে আসেনি।
বিএনপির রাজনীতি তখনও ‘প্রান্তিক (দুর্বল অর্থে) অবস্থায়’ থাকার কথা বলা হলেও ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন আনার জন্য তাদেরকেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দল হিসেবে তুলে ধরা হয়।
কেবল আইআরআই নয়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিসের সিনিয়র ডিরেক্টরও বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে। যে সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির অর্থায়নে মার্কিন লবি ফার্ম হিসেবে কাজ করে আসছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালসহ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বিএনপির অংশীদার হিসেবে ব্লুস্টার স্ট্র্যাটেজিসের সাথে চুক্তি রয়েছে বিএনপির।