প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাজধানীর গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমামের বাসায় ছাত্র-জনতার অভিযানের নামে বিশৃঙ্খলা, তছনছ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ ছিলো সেখানে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা আত্মগোপন করে আছেন এবং বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র ও অর্থ মজুত রয়েছে।

এই অভিযানে ছাত্র-জনতার একটি দল তল্লাশি চালায় এবং সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বাড়ির বিভিন্ন অংশ ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, ছাত্র-জনতার নামে ‘মব’ (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) সৃষ্টি করে অভিযান ও তল্লাশির বিষয়টি আগে থেকে আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর সদস্যরা জানতো। পুলিশ চাইলে বিষয়টি আগেই থামাতে পারতো। এর আগেও গত সোমবার (৩ মার্চ) রাতে একই অভিযোগে পুলিশের উপস্থিতিতে একই বাসায় তল্লাশি করা হয়।
অভিযানের দিন কী ঘটেছিল?
গত মঙ্গলবার (৪ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টার দিকে গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দিন পার্কের সামনে ছাত্র-জনতার একটি দল জড়ো হয়। এরপর তারা রাত ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রী গুলশান-২ নম্বরে ৮১ নম্বর সড়কের কনকর্ড নামে বাসার সামনে যায় এবং প্রবেশের চেষ্টা করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গেটের নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দিলে কিছু শিক্ষার্থী গেট টপকে ভেতরে ঢুকে যায়। পরে গেট খুলে শতাধিক মানুষ ভবনের পাঁচতলায় প্রবেশ করে তল্লাশি চালায়। তল্লাশির সময় তারা বিভিন্ন কক্ষ খুঁজে দেখে, লাগেজ ও সিন্দুক খুলে ফেলে এবং বাসার আসবাবপত্র তছনছ করে।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
অভিযানে ছাত্র প্রতিনিধি রাজিব হোসেন দাবি করেন, তল্লাশি বিষয়টি আগে থেকেই গুলশান থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনী জানতো। তিনি বলেন, “সকাল থেকেই আমরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পুলিশ জানায়, তারা অভিযানে সরাসরি যুক্ত হবে না, তল্লাশি শুরু করলে পুলিশ এসে যোগ দেবে। এছাড়াও পুলিশের পরামর্শে আমাদের তল্লাশিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়েছি।”
তবে গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোকলেছুর রহমান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, “এমন কোনও নির্দেশনা পুলিশ দেয়নি। বরং গত সোমবার রাতে কিছু শিক্ষার্থী একই অভিযোগ নিয়ে এসেছিল। তখন আমরা তাদের নিয়ে ভবনের পাঁচতলায় তল্লাশি চালাই, কিন্তু কিছু না পেয়ে তারা ফিরে যায়।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে আছে, অবৈধ অস্ত্র আছে— এ ধরনের অভিযোগ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর প্রবণতা বাড়ছে। তবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো।”
অভিযানে কী পাওয়া গেলো?
অভিযান পরিচালনাকারীদের দাবি ছিল, তানভীর ইমামের বাসায় অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বিপুল অর্থ মজুত রয়েছে। তবে তল্লাশির পর এসবের কিছুই পাওয়া যায়নি।
অভিযানের প্রায় আধা ঘণ্টা পর গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তারা ছাত্র-জনতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ধীরে ধীরে সবাইকে সরিয়ে দেয়।
অভিযান চলাকালে তানভীর ইমাম বা তার পরিবারের কোনও সদস্যকে বাসায় পাওয়া যায়নি। শুধু কয়েকজন স্টাফ ও কাজের লোক উপস্থিত ছিলেন।
মব সৃষ্টির নেতৃত্ব কথিত বিএনপি নেতা
ছাত্র-জনতার এই অভিযানে নেতৃত্ব এবং মূল পরিকল্পনাকারী বিএনপি পরিবহন শ্রমিক দলের নেতা জুয়েল খন্দকার ওরফে কাউসার ছিলেন বলে দাবি করেন ছাত্র প্রতিনিধি রাজিব হোসেন। তিনি দাবি করেন, বিএনপি নেতা ও পরিবহন শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল খন্দকার ওরফে কাউসারের পরামর্শেই তারা অভিযান পরিচালনা করেন।
রাজিব বলেন, “কাউসার আমাদের জানিয়েছিলেন, ওই বাড়িতে আওয়ামী লীগের কিছু সহযোগী আত্মগোপনে আছেন এবং সেখানে অবৈধ অস্ত্র ও টাকা রাখা হয়েছে। এরপর আমরা নিজেরা তথ্য সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়ে তল্লাশির সিদ্ধান্ত নেই।”
তল্লাশির ঘটনায় অভিযোগ ও গ্রেফতার তিনজন
কনকর্ড নামে ওই বাড়ির কেয়ারটেকার আব্দুল মান্নান এ বিষয়ে গুলশান থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন, যেখানে তিনি তল্লাশির নামে ভাঙচুর, লুটপাটের চেষ্টা ও নিরাপত্তা বিঘি্নত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।
এ ঘটনায় পুলিশ তল্লাশি ও হামলার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন- শাকিল খন্দকার (২৪), জুয়েল খন্দকার ওরফে কাউসার (৪৮) (বিএনপি নেতা), শাকিল আহমেদ (২৮)।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
এ ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের নিষি্ক্রয়তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তারা বলছেন, ছাত্র-জনতা যদি পুলিশের অনুমতি নিয়ে অভিযান চালিয়ে থাকে, তাহলে কেন পুলিশ তাদের সঙ্গে যায়নি? অভিযানের সময় পুলিশের উপস্থিতি থাকার পরও কেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো, এ ধরনের তল্লাশি যদি অবৈধ হয়, তাহলে যারা এতে অংশ নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেকোনও তল্লাশি বা অভিযোগের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। যদি অভিযোগ সত্য হয়, তবে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অন্যথায়, এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত তল্লাশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।
সরকারের সতর্কবার্তা
এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জনগণকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যদি কোথাও কোনও অবৈধ অস্ত্র বা অর্থের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে হবে এবং তারা যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেবে।
এখন দেখার বিষয়, এই ঘটনার পর গ্রেফতার ব্যক্তিদের কী শাস্তি হয় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার কী ব্যবস্থা নেয়।