ইসরায়েলের ‘টার্গেটেড কিলিং’কৌশল কি সফল?

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ লেবাননের ইরানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা হিসাব চুকিয়ে দিয়েছি’। কিন্তু ইসরায়েলের অতীতের টার্গেটেড কিলিং কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দেশটির প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসলে কতটা হবে? মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম আল মনিটরের এক প্রতিবেদনে এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।

নাসরাল্লাহর মৃত্যু ইসরায়েলকে যে শান্তি এনে দেবে বলে আশা করা হয়েছিল, তার বদলে ইরান থেকে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। তেহরান তাদের লেবাননের মিত্র ও সেই সঙ্গে নিহত ইরানি জেনারেলের প্রতিশোধ নিতে চায়। ইসরায়েল পাল্টা হামলার অঙ্গীকার করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলি পাল্টা আঘাত কেবল সময়ের ব্যাপার।

লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর ১৯৮২ সালে ইরানের সহায়তায় হিজবুল্লাহ গঠিত হয়। সম্প্রতি ইসরায়েলি হামলায় নাসরাল্লাহ এবং হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের নিহত হওয়ায় সংগঠনটি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ইসরায়েলের এই হত্যার কৌশলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

১৯৯২ সালে নাসরাল্লাহর পূর্বসূরি আব্বাস আল-মুসাবিকে হত্যা করেছিল ইসরায়েল। কিন্তু এতে হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়নি। ৩২ বছর বয়সে নাসরাল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং পরে ইসরায়েলের ভাষায়, ‘শুধু আরেকজন সন্ত্রাসী নন’, বরং ‘আসল সন্ত্রাসীর’ তকমা পেয়েছিলেন।

২০০৮ সালে দামেস্কে গাড়ি বোমা হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার ইমাদ মুঘনিয়েহকে হত্যার পেছনেও ইসরায়েলের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডও হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি দুর্বল করেনি।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ডেভিড উড বলেন, এসব হত্যাকাণ্ড হিজবুল্লাহর সামরিক কার্যক্রমকে দুর্বল করেনি। বরং তাদের সামরিক কার্যক্রম আরও এগিয়ে গেছে।

তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। ইসরায়েলি আঘাতের ফলে হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব প্রায় ধ্বংস হয়েছে, যা সংগঠনটির জন্য ‘নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ’ বলে মন্তব্য করেছেন উড।

‘ঈশ্বরের ক্রোধ’

১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের বন্দুকধারীরা ১১ জন ইসরায়েলিকে হত্যা করার পর ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং কৌশলের সূচনা ঘটে। এর জবাবে ইসরায়েল ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’ নামক একটি অভিযান শুরু করে। এর লক্ষ্য ছিল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নেতাদের হত্যা করা।

এরপর থেকে এই কৌশল আরও বিকশিত হয়। হিজবুল্লাহ ও হামাসের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে ইসরায়েল। তবে, ভুলও করেছে। যেমন ১৯৯৭ সালে হামাস নেতা খালেদ মেশালকে বিষ প্রয়োগের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এতে ইসরায়েল-জর্ডান সম্পর্কের টানাপড়েন দেখা দেয় এবং পরে ইসরায়েল জর্ডানের কাছে আটক দুই গুপ্তচরের বিনিময়ে হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা আহমেদ ইয়াসিনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

অক্টোবরের ৭ তারিখে হামাসের আক্রমণের পর থেকে ইসরায়েল বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর মধ্যে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ, হিজবুল্লাহ কমান্ডার ফুয়াদ শুকর ও সর্বশেষ নাসরাল্লাহ রয়েছেন। শুকরের মৃত্যুর দায় ইসরায়েল স্বীকার করেছে। কিন্তু হানিয়াহর ইরানে মৃত্যুর বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। ‘ব্যাপক ধ্বংস’

কিছুদিন আগে ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তলমুদ থেকে উদ্ধৃত করে টার্গেটেড কিলিং-এর পক্ষে সাফাই গেয়ে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘যে তোমাকে মারতে আসে, তাকে আগে মেরে ফেলো।’

ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষক জন হান্নাহ বলেন, অক্টোবরের ৭ তারিখের হামলার আগে পর্যন্ত ইসরায়েল অপেক্ষা করছিল। কিন্তু একই সময়ে হামাস ও হিজবুল্লাহর অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে উঠছিল। ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েল তাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন আনে এবং হামাস ও হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করার দিকে মনোনিবেশ করে।

চলতি সপ্তাহে ইসরায়েল ঘোষণা করেছে, তারা দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর ‘সীমিত’ হামলা চালাচ্ছে। কারণ হামাসকে সমর্থন জানিয়ে হিজবুল্লাহ দেশটির উত্তর সীমান্তে আক্রমণ করে আসছে। ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর এই আক্রমণ গত এক বছরে সীমান্তের ৬০ হাজারের বেশি ইসরায়েলিকে স্থানচ্যুত করেছে।

তবে নাসরাল্লাহকে হত্যার পর আদৌ কি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে? এ নিয়ে ইসরায়েলের ভেতরেও বিতর্ক রয়েছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিশ্লেষক ইয়োসি মেলমানের মতে, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছাড়া নাসরাল্লাহর মৃত্যু কোনও ‘গেম-চেঞ্জার’ হবে না।

মেলমান বলেন, যত বড় আঘাতই হোক না কেন হিজবুল্লাহ উত্তর সীমান্তে আক্রমণ চালিয়ে যাবে। আর যতক্ষণ গোলাবর্ষণ চলবে, ততক্ষণ উদ্বাস্তুদের ফেরা হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.