ঈদের আগে বকেয়া ছাড়া ঘরে ফেরা হবেনা

প্রশান্তি ডেক্স ॥ কদিন পড়েই ঈদ, বেতন-বোনাসের অনিশ্চয়তা কিছুতেই কাটছে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। স্বামী কাজ করতে পারে না, গলা দিয়ে রক্ত যাচ্ছে। চিকিৎসা করাতে পারি না। ধার-দেনা করেছি ২০ হাজার টাকার বেশি। বকেয়া বেতন, ঈদ বোনাস, ছুটির টাকা সব মিলিয়ে ৪০ হাজার টাকা পাবো। কিন্তু টাকা না পেলে বাড়ি যাবো কীভাবে?

কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেল লিমিটেডের পোশাক শ্রমিক কলি আক্তার। তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে তিনি গাজীপুর থেকে রাজধানীর কাকরাইলে শ্রম ভবনের সামনে এসেছেন। তবে আসার জন্য বাস ভাড়া পর্যন্ত ছিল না তার কাছে। পরিচিত একজনের কাছ থেকে ধার করে মাত্র ৭০ টাকা নিয়ে তিনি এখানে এসেছেন।

কলির স্বামী শারীরিকভাবে অসুস্থ, কাজ করতে পারেন না। দুই সন্তান মাদ্রাসায় পড়ছিল, কিন্তু বকেয়া বেতনের কারণে মাদ্রাসার টাকা দিতে পারেননি, তাই সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। স্বামীর চিকিৎসার জন্য টাকাও নেই তার কাছে।

শুধু কলি নন, তার মতো হাজারও পোশাক শ্রমিক এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শ্রম ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন পোশাক শ্রমিক আসমা। বাসা থেকে ফোন এসেছে, ফোনে দুই শিশু-সন্তানের খবর নিচ্ছেন। আট বছর ও পাঁচ বছরের দুই সন্তানকে বাড়িতে রেখে এসেছেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘বাচ্চাদের আল্লাহ দেখবে। তিন দিন ধরে এখানে আছি, টাকা না পেলে বাড়ি যাওয়ার ভাড়াও নাই।’

আসমা বলেন, ‘কেউ একটা পানির বোতল দেয়নি, কিন্তু পুলিশ আমাদের মারতে পারলো। একের পর এক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে শ্রমিকরা।’

শ্রম ভবনের সামনে বেতন-বোনাসের দাবিতে অবস্থান নেওয়া পোশাক শ্রমিকরা ঈদের আগে পাওনা না পেলে ঘরে ফিরবেন না শ্রমিকরা।

পোশাক শ্রমিক ছন্দা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্রম ভবনের সামনে। চোখে ক্লান্তি স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘মেয়ে সেদিন বলেছে মা ঈদের জামা কিনবো না? কিছু বলতে পারি নাই। এক সেকেন্ড বুঝেন? এক সেকেন্ড হিসাব করে করে কাজ করি আমরা। এভাবে হাত চলে আমাদের। কিন্তু টাকার কোনও হিসাব নেই। টাকা দেওয়ার নাম নেই।’

মরিয়ম নামে আরেক পোশাক শ্রমিক বলেন, ‘সবার ঈদ আছে, আমাদের নেই। ৪০ হাজার টাকা পাওনা, তা না পেলে বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে কী বলবো? এখানে খেয়ে না খেয়ে পড়ে আছি। ঘুমাই নাই রাতে। শ্রমিকদের পাশে কেউ নাই।’

মরিয়মের মতো হাজারখানেক শ্রমিক তিন দিন ধরে বিজয়নগরের শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। গাজীপুরের টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেল লিমিটেড, অ্যাপারেল প্লাস ইকো লিমিটেড, রোর ফ্যাশন, স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টস ও ডার্ড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে আন্দোলন করছেন।

এর আগে গত মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) দুপুরে আন্দোলনরত শ্রমিকরা সচিবালয়ের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত ৩০ জন শ্রমিক ও পাঁচ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

কর্মসূচি অব্যাহত, কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। শ্রমিক নেতা মো. মাসুদ মিয়া বলেন, ‘আজকে আমরা খালি হাতে আছি, কিন্তু কাল খালি হাতে থাকবো না। আমাদের পাওনা বুঝিয়ে না দিলে গাজীপুরের মহাসড়ক অবরোধ করা হবে।’

তাদের প্রশ্ন, ‘আমরা যদি ভালো থাকতে না পারি, তাহলে ঈদ আনন্দ কাদের জন্য? ’শ্রমিকদের পাশে কে দাঁড়াবে? এমন প্রশ্ন করছেন আন্দোলনকারী পোশাক শ্রমিকরা। তারা বলছেন, বছরের পর বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছেন পোশাক শ্রমিকরা। অথচ বেতন-বোনাসের জন্য তাদের রাস্তায় নামতে হয়। ঈদের আগে যখন সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন তারা না খেয়ে আন্দোলন করছেন। তাদের প্রশ্ন, ‘আমরা যদি ভালো থাকতে না পারি, তাহলে ঈদ আনন্দ কাদের জন্য?’ প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যায় শ্রম ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে অ্যাপারেল প্লাস ইকো লিমিটেডের শ্রমিক রাজু মিয়া বলেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের বকেয়া মজুরি, খোরাকি ভাতা, ছুটির টাকা এবং চলতি মাসের মজুরি পরিশোধের দাবিতে অ্যাপারেল প্লাস ইকো লিমিটেড ও টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের শ্রমিকরা সরকার ও মালিকপক্ষকে বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছন। তারা বলেন, এই সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে রাজপথে অবস্থান নেবেন। কিন্তু তাদের দাবী কেউই মেনে নেয়নি। এখন যা হবার তাই হচ্ছে এবং বাস্তবতা দৃশ্যমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published.