বাড়ছে মন্দ ঋণ আর প্রভিশন ঘাটতিও দ্বিগুণ

প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে মন্দ মানের ঋণের (আদায় না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি) পরিমাণ দ্রুত বাড়ায় ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ শতাংশের বেশি এখন মন্দ মানের, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম।

অন্তবর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে বিগত ১৫ বছরে যে পরিমাণ মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল কিংবা ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো। শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে ব্যাংক খাত। মন্দ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ আকাশ ছুঁয়েছে। কমিটির মতে, দেশের ব্যাংক খাত এক ধরনের ‘কৃষ্ণগহ্বরে’ ঢুকে গেছে।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। নামে-বেনামে ঋণ অনুমোদন, বিদেশে অর্থপাচার এবং ব্যাংকের মালিকানা জোরপূর্বক পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে।

খেলাপি ঋণ ও মন্দ ঋণের চিত্র : গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা-যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দ ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা- যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪.৩১ শতাংশ।

বছরের শেষ ছয় মাসে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেছে এবং তাদের নিট আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কারণ এসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক, যা ব্যাংকের মূলধন ও পরিচালন ব্যয়ের ওপর চাপ বাড়িয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থা : মন্দ ঋণের সবচেয়ে বেশি চাপ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ওপর। ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা, যা ছয় মাস আগেও ছিল ৭৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ছয় মাসে এই ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ বেড়েছে ৪৫ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে দ্রুতগতিতে। একই সময়ে এ খাতে মন্দ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা, যা ছয় মাস আগে ছিল ৮২ হাজার ৩০১ কোটি টাকা।

সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ যেসব ব্যাংকে : প্রতিবেদনে দেখা যায়, মন্দ ঋণের শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক, যেখানে এর পরিমাণ ৬২ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক ২৪ হাজার ১২৬ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ২৩ হাজার ৯৪০ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ২০ হাজার ৪৮৭ কোটি, সোনালী ব্যাংক ১৫ হাজার ১৯৫ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক ১৫ হাজার ১৮০ কোটি, এবং সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক ১১ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃত মন্দ ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। কারণ অনেক ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে রাখে। পাশাপাশি ‘রাইট-অফ’ করা ঋণও প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করছে।

প্রভিশন ঘাটতি দ্বিগুণ : খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতিও উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষে অন্তত ১৩টি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগেও ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাত্র এক প্রান্তিকের ব্যবধানে ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৫০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা।

প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় সবচেয়ে ওপরে রয়েছে জনতা ব্যাংক ২৭ হাজার ১৬০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ১৮ হাজার ৭২০ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ১৩ হাজার ১৫৩ কোটি, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক ১০ হাজার ৬০৩ কোটি, এবং সোনালী ব্যাংক ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা।

মন্দ ঋণের প্রভাব : মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ছে, যার প্রভাব ফেলছে সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের ওপরও। ব্যবসায়িক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে, ফলে নতুন বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। একইসঙ্গে আমানতকারীরা তাদের সঞ্চয় নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন, যা অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংক খাতের এই দুরবস্থা মূলত ঋণ জালিয়াতি, দুর্বল তদারকি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে হয়েছে। বিশেষ করে, মন্দ ঋণের পরিমাণ কমাতে এবং খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংকিং খাত আরও সংকটে পড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘মন্দ ঋণ বৃদ্ধির পেছনে ব্যাংকগুলোর সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক প্রভাব বড় কারণ।’ তিনি বলেন, ‘ঋণ প্রদানের সময় যথাযথ যাচাই-বাছাই ও তদারকি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধে সক্ষম হন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.