মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০লাখ নয়, তারচেয়ে বেশি

প্রশান্তি ডেক্স ॥ পৃথিবীর কোনও জাতি তার শ্রেষ্ঠতম অর্জন নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে না। কিন্তু বাংলাদেশিরা তাদের হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশি টানাহেঁচড়া করাতে শেষ অব্দি সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ। বড় দাগে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৭৫ থেকে এখন পর্যন্ত রাজনীতির পাঁকেচক্রে এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপরাজনীতির ফলে সারা দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো দল আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং এ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা।

বাংলাদেশের অন্য আরেকটি বৃহত্তম দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সামরিক কর্মকর্তা এবং পরবর্তীতে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

বড় দুটি দলের প্রধান নেতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাতে দুজনেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যেমন ধারণ করেন, তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিজেদের শেকড় বলে মনে করার ব্যাপারেও তাদের রয়েছে অন্তর্গত উপলব্ধি। এটা ঠিক যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তার দল বিএনপিতে বাম, ডান ও মধ্যপন্থিসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরাও এসে জড়ো হয়েছিলেন।

এই বাস্তবতা সত্ত্বেও, আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি এ দুটি বড় দলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব, মালিকানা ও শরিকানা নিয়ে এ দুটি দলের মধ্যে বিস্তর বাদানুবাদ হয়েছে। এতে বাতাস দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তি। মাঝখান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিতর্কিত হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয়  যে জাতীয় সংগীত, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের সংবিধান, একুশে ফেব্রুয়ারি ও একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিএনপির আদর্শিক লক্ষ্য নিয়ে বিতর্ক নেই। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে জাতীয় সংগীত বাদ ও সংবিধানের কবর রচনার কথা বলা হলো, এখন সেকেন্ড রিপাবলিকের নামে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। এ রকম একটি অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের ব্যাপারে বিএনপি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান সুপরিস্ফুট হয়েছে।

গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে আওয়ামী সরকারের তরফ থেকে বিএনপি ও জামায়াতকে নির্মূল করার সর্বাত্মক চেষ্টা হয়েছে। এদিকে মানসম্পন্ন শিক্ষা, যে শিক্ষার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মানবিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা পায়, সেটি একবারেই উপেক্ষিত ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা কিছু পেলেও মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা যে তরুণ সম্প্রদায় পায়নি, তার প্রমাণ হচ্ছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাম্প্রদায়িকতা, কূপমন্ডূকতা ও অসহিষ্ণুতা। এদিকে পীর আউলিয়া কর্তৃক প্রচারিত ‘উদার ইসলামের’ বিরুদ্ধে পলিটিক্যাল ইসলামওয়ালারা বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। লালন, হাছন রাজাসহ আমাদের শেকড়ের গান-বাজনা ও দেশীয় আধ্যাত্মিক চেতনাকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব কিছুর সুযোগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তি কৌশলে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিবিরোধী নানা চিন্তা ভাবনা ঢুকিয়ে দিয়েছে।

ফলে ৫ আগস্টের পরে আমরা এমন অনেক কিছু দেখছি, যেটি নজিরবিহীন এবং বাংলাদেশের নিজস্ব অস্তিত্বকে বিপন্ন করার শামিল। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। বুঝলাম, শেখ হাসিনার বাবার বাড়ি ওটি। কিন্তু বীর শ্রেষ্ঠদের ম্যুরাল কেন ভাঙা হলো? জগদীশ চন্দ্র বসু, জীবনানন্দ দাশের নাম কেন পাল্টে ফেলা হলো? বেগম রোকেয়ার ছবি কেন কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো? স্থানে স্থানে নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? নারী স্বাধীনতার ওপর হামলা কেন হচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ শহীদ যে অসাম্প্রদায়িক, আলোকিত ও সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটি কি তাহলে তিরোহিত হতে চলেছে?

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কুতর্ক, অপতথ্যু এসবের সূত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যার বিতর্কটা এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে কি ৩০ লাখ, নাকি ৩ লাখ শহীদ হয়েছিলেন? এ কুতর্কটি ৫ আগস্টের পরের নয়, অনেক আগের। তবে খুব কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ হত্যার কথাটি প্রথম উচ্চারণ করেন পাকিস্থানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইয়াহিয়া খান। নরহন্তারক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের এক সভায় বলেছিলেন, “তাদের (বাঙালিদের) ৩ মিলিয়নকে মেরে ফেলো এবং বাকিরা সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।” ২০০৫ সালের ২৩ জুন Asia Times এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্থানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে বাঙালির প্রতিরোধকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে সামরিক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানায় আক্রমণ চালায়। বাংলাপিডিয়ার ‘Genocide, ১৯৭১’ শীর্ষক নিবন্ধ মতে, ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এ প্রথম ৩ দিনে পাকিস্থান সামরিক বাহিনী ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে ৫০ হাজার মানুষ হত্যা করে।

এদিকে, বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন শুরু হওয়ার পরে এক রাতেই ৫ হাজার থেকে ১ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘প্রভদা’য় বলা হয়, পাকিস্থান দখলদার বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। গিনিস বুক অব রেকর্ডস (Guinness Book of Records)  বিংশ শতাব্দীর প্রথম ৫টি ভয়াবহতম জেনোসাইডের মধ্যে বাংলাদেশের জেনোসাইডকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- (১) ২০১৩ সালের জুলাই মাসে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলার রায় প্রদান করার সময় এ তথ্যটি উদ্ধৃত করে।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি আনোয়ারুল হক জানান যে ১৯৭১ সালের ১২ মে তারিখে ওয়াশিংটন ইভনিং স্টার পত্রিকায় সাংবাদিক মর্ট রোজেনব্লামের করা ‘Vultures too full to fly’ ভষু’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ৫ লাখ মানুষ হত্যার এক করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়। বিচারপতি হক এমন সব গ্রন্থ উদ্ধৃত করেন যেখানে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে হাজার হাজার নিরপরাধ ও নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। বিচারপতি হক পাকিস্থানের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজীর ‘The Betrayal of East Pakistan’ এবং রবার্ট পেইন পেইন (Robert Payne) কর্তৃক লেখা ‘Massacre’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেন।

নানা প্রামাণিক তথ্য-উপাত্ত বলছে যে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২৫ মার্চ রাত থেকে যে জেনোসাইড শুরু করে, সেটি বাছ-বিচারহীনভাবেই চলতে থাকে দিনের পরে দিন, মাসের পর মাস। ফলে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি অতিরঞ্জিত তো নয়ই, বরং কারও কারও মতে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। এ ব্যাপারে রুডলফ জোসেফ রামেলের কথা উল্লেখ করা যায়। রামেলের ‘উবধঃয ইু এড়াবৎহসবহ’ শীর্ষক গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘স্ট্যাটিটিকস অব পাকিস্থান ডেমোসাইড- এসটিমেটস, ক্যালকুলেশনস অ্যান্ড সোর্সেস”। যোসেফ রামেল নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত হিসাব ও বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

এটা ঠিক যে কোনও জেনোসাইডে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি নিখুঁতভাবে নির্ণয় করাটা কঠিন। যেমন বলা হয়, মার্কিনিরা (মূলত ইউরোপিয়ান সেটলারস) ৬ লাখ থেকে ১০ লাখ আমেরিকান আদিবাসীকে হত্যা করেছিল। কম্বোডিয়ার জেনোসাইডে খেমাররুজরা ১.৫ থেকে ৩ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল। একইভাবে বাংলাদেশের জেনোসাইডের একটি সর্বনিম্ন সংখ্যা, আরেকটি সর্বোচ্চ সংখ্যা রয়েছে। কেউ কেউ এটিকে ৩ লাখ থেকে ৩০ লাখ বললেও, বৈশ্বিক নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটি ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ। আবার মুক্তিযুদ্ধে ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ শহীদ হওয়ার তথ্যের পেছনেও প্রামাণিক সূত্র রয়েছে।

প্রথমত, ইয়াহিয়া খান ৩ মিলিয়ন বাঙালি হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘প্রাভদা’ বঙ্গবন্ধু পাকিস্থান জেলে থাকা অবস্থায় ৩ মিলিয়ন বাঙালি হত্যার কথা বলেছে। এদিকে রুডলফ জোসেফ রামেলও ৩০ লাখের কথা বলছেন। আবার ডেমোগ্রাফি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কেউ কেউ সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশিও হতে পারে। জনমিতির এ ব্যাখ্যাগুলোও বিশ্বাসযোগ্য।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.