প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ চীন গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এই সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১৪৫ শতাংশে বাড়ানোর জবাব হিসেবে এসেছে। বাণিজ্যযুদ্ধের এই পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি করবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প অল্প সময়ের জন্য কয়েকটি দেশের ওপর শুল্ক স্থগিত রাখার ঘোষণা দিলেও তা বাজারে স্থিতি ফেরাতে পারেনি। গত শুক্রবার বিশ্বের শেয়ার বাজারগুলো আবারও নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। ডলার দুর্বল হয় এবং মার্কিন সরকারি বন্ডের দাম আরও পড়ে যায়। বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয় স্বর্ণের দাম পৌঁছে যায় রেকর্ড উচ্চতায়।
জেনাস হেন্ডারসনের গ্লোবাল মাল্টি অ্যাসেট প্রধান অ্যাডাম হেটস বলেন, দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় এখন মন্দার ঝুঁকি অনেক বেশি। গত শুক্রবার এশীয় শেয়ার বাজারগুলো ওয়াল স্ট্রিটের ধারাবাহিক পতন অনুসরণ করে।
ইউরোপেও চীনের নতুন শুল্কবৃদ্ধির প্রভাবে এসটিওএক্সএক্স ৬০০ সূচক ১ শতাংশের বেশি পড়ে যায়, যা সপ্তাহজুড়ে আরও পতনের ইঙ্গিত দেয়। কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম দিকের পর এতটা অস্থিরতা আর দেখা যায়নি।
ক্যাপিটাল ডটকমের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক কাইল রড্ডা বলেন, যে পতন ঘটছে, তা বিপজ্জনক। মুদ্রা ও বন্ডবাজারের পতন কখনোই ভালো বার্তা দেয় না। এটি শুধু প্রবৃদ্ধির ধীরগতির নয়, বরং কাঠামোগত অনিশ্চয়তার প্রতিফলন।
মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট গত বৃহস্পতিবার বাজারের অস্থিরতাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি মার্কিন অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাবে। হোয়াইট হাউজ জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে। ভিয়েতনাম জানিয়েছে, তাদের ভূখন্ড ব্যবহার করে যেন চীনা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ না করতে পারে, সে ব্যবস্থা তারা নেবে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা একটি বাণিজ্য টাস্কফোর্স গঠন করেছেন, যা আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সপ্তাহের শুরুতে অন্যান্য দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা স্থগিত করলেও ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেন ১৪৫ শতাংশে। জবাবে চীন গত শুক্রবার নতুন শুল্ক আরোপ করে, যদিও বেইজিং জানায়, তারা এটাই সর্বশেষ পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করছে।
চীনের অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও শুল্ক আরোপ করে, তা অর্থনৈতিকভাবে কোনও অর্থ বহন করবে না এবং ইতিহাসে এটি একটি তামাশা হিসেবে পরিগণিত হবে।
তবে তারা এটাও বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি কেবল সংখ্যার খেলা খেলেই যায়, চীন আর সেই খেলায় অংশ নেবে না। এর মাধ্যমে চীন অন্য ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
হোয়াইট হাউজে গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি মনে করেন চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্ভব এবং তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসেবে সম্মান করেন। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত এমন একটি সমাধান আসবে যা উভয় দেশের জন্য ভালো হবে।
বেইজিংয়ে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের সঙ্গে সাক্ষাতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধে কোনও পক্ষই বিজয়ী হয় না। চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একত্রে কাজ করে একতরফা বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের তেমন আশ্বস্ত করতে পারেনি। ইউরো-ডলারের মান বাড়ায় ইউরোপীয় পণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।
গত শুক্রবার ইউরো তার তিন বছরের সর্বোচ্চ মানে পৌঁছে যায় ডলারের বিপরীতে এবং ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয় চীনা ইউয়ানের বিপরীতে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একে ‘নাজুক বিরতি’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই ৯০ দিনের বিরতি মানে ৯০ দিন অনিশ্চয়তা, আমাদের দুই পাড়ের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত বৃহস্পতিবার তাদের পাল্টা শুল্ক স্থগিতের ঘোষণা দেয়। তবে জার্মানির অর্থমন্ত্রী জোয়র্গ কুকিস বলেন, যদি আলোচনায় অগ্রগতি না হয়, তবে আমরা ফের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবতে বাধ্য হব।
বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার সামনে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইউরোপ, এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল এখন যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্ধের আলোকে নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করছে। শেয়ার বাজারে ধস, মুদ্রার অস্থিরতা ও বন্ডবাজারের পতনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির আড়ালে স্পষ্ট হচ্ছে অর্থনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের এক বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে তা কেবল ব্যবসা নয়, শ্রমবাজার, ভোক্তা মূল্য ও বিশ্ব রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলবে।