যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ: বিপজ্জনক খেলা, পিছু হটার কোন পথ খোলা নেই

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ যেন আরও এক ধাপে এগিয়ে গেছে। এবার যেন সত্যিই ‘পিছু হটার কোনও রাস্তা নেই’। পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ, একে অপরকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’-র সঙ্গে তুলনা, আর একে অপরকে ‘চূড়ান্তভাবে মোকাবিলার’ হুঁশিয়ারি পরিস্থিতিকে ঠেলে দিচ্ছে অনিবার্য সংঘাতের দিকে।

গত বুধবার চীন ঘোষণা করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবে। এর কয়েক ঘণ্টা আগেই কার্যকর হয় ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ৭৫ শতাংশ শুল্ক, যার ফলে চীনে রফতানি হওয়া সব মার্কিন পণ্যে মোট ৮৪ শতাংশ কর পড়বে। পাল্টা জবাবে, গত বুধবার বিকেলে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, চীনা পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করা হবে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের এমন ‘দাম্ভিক ও দমনমূলক আচরণ’ কখনোই মেনে নেবে না এবং উপযুক্ত জবাব দেবে। একই সঙ্গে তারা মার্কিন ১২টি কোম্পানির ওপর রফতানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং আরও ৬টি কোম্পানিকে ‘অবিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান’-এর তালিকায় যুক্ত করেছে। যার অর্থ, এসব কোম্পানি আর চীনে ব্যবসা করতে পারবে না।

শুল্ক যুদ্ধের এই উত্তেজনাকর ধাপে চীনা নেতা শি জিনপিং ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে যেন শুরু হয়েছে ‘কেউ আগে নতি স্বীকার করবে না’ এরকম জাতীয় বিপজ্জনক এক খেলা। কেউই নিজেদের দুর্বল দেখাতে চান না, কেউই পিছু হটতে চান না। অথচ দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে প্রযুক্তি, ভূরাজনীতি ও তাইওয়ান ইস্যুতেও।

ওয়াশিংটনের থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর উপদেষ্টা স্কট কেনেডি বলেন, ট্রাম্প এর আগে কখনও এমন প্রতিপক্ষ পাননি, যারা তার মতোই রূঢ় কৌশল অবলম্বন করতে রাজি। চীনের জন্য এটি শুধু বাণিজ্য নয়, এটি সার্বভৌমত্ব ও কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্বের প্রশ্ন।

চীনের অর্থনীতি এমনিতেই দুর্বল, আবাসন খাতে ধস আর বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাবে। এমন পরিস্থিতিতে এই বাণিজ্যযুদ্ধ যেন এক ‘অর্থনৈতিক ভূমিকম্প’। সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডিন উ সিনবো বলেন, এটি সাময়িক অস্থিরতা, না দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা-তা এখনও পরিষ্কার নয়।

যদিও এখনও চূড়ান্ত বিচ্ছেদের পথে হাঁটেনি দুই দেশ। স্টারবাকস কিংবা টিকটকের মতো মার্কিন-চীনা কোম্পানিগুলো উভয় দেশেই সক্রিয়। আর চীনা ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনও ডলারভিত্তিক আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। তবু পরিস্থিতি যদি ট্রাম্প চীনা ব্যাংকগুলোর লাইসেন্স বাতিল বা ‘সুইফট’ পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বাদ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেন, তবে তা হবে সম্পর্কের এক বিপজ্জনক মোড়।

চীন একদিকে নিজেদের ‘অত্যাচারিত’ দেখাতে চাচ্ছে, অন্যদিকে চিরচেনা নীতিতে নিজ দেশের বাজার বিদেশিদের জন্য সীমিত করে রেখেছে এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে চড়া ভর্তুকি দিয়ে আসছে। অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন নিজেরাই ‘বাণিজ্যিক বৈষম্যের শিকার’ বলে দাবি করছে।

শি জিনপিং সরাসরি মার্কিন শুল্ক নিয়ে কিছু না বললেও গত বুধবার পলিটব্যুরোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ‘প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার’ এবং ‘সরবরাহ শৃঙ্খল সুসংহত’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ‘আমরা নির্যাতনের কাছে মাথা নত করব না।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বন্ধের প্রতিক্রিয়া কেবল দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব পড়বে-নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি প্রতিরোধ কিংবা আর্থিক ব্যবস্থাপনা- সবখানেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন সহযোগিতা প্রয়োজন। অথচ বাণিজ্যের মূল স্তম্ভ ভেঙে পড়লে এইসব ক্ষেত্রেও অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।

চীন বলছে, তারা এখন আর মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরশীল নয়। প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চীনের রফতানি-নির্ভর কোম্পানিগুলো-বিশেষত ফার্নিচার, খেলনা, পোশাক ও গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই নির্ভরশীল। এই ধাক্কা তাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলবে বলে মনে করেন পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিভাগের পরিচালক ওয়াং ইউশেং। তিনি বলেন, চীনা পণ্যের আর কোনও গন্তব্য থাকবে না। এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে।

করোনার পর নিরাপত্তা আইনের কারণে বহু বিদেশি বিনিয়োগ ইতোমধ্যে চীন থেকে সরে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ ফেরাতে শি জিনপিং সম্প্রতি বিদেশি নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং বলেছেন, চীনের উন্নয়নে তাদের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ।

তবু গোপনে চীন প্রস্তুতি নিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের। এর ইঙ্গিত দিচ্ছে শীর্ষ চীনা ব্লগারদের সরকারি অনুমতি নিয়ে উন্মুক্ত মত প্রকাশ। হাভার্ড পড়ুয়া চীনা ব্লগার রেন ই বা চেয়ারম্যান র‍্যাবিট বলছেন, এই যুদ্ধ শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি এক প্রকার ‘ধোয়াবিহীন যুদ্ধ’। সেটা বুঝেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

তিনি চীনের সম্ভাব্য পাল্টা কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছেন মার্কিন পরামর্শ ও আইন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বিধিনিষেধ, মার্কিন সয়াবিন ও মুরগির মাংস আমদানিতে কাটছাঁট এবং ফেন্টানিল রফতানি বন্ধে সহযোগিতা বাতিলের মতো পদক্ষেপ।

বিশ্লেষকদের মতে, উভয় পক্ষই এখন চাপের মুখে অবস্থান করছে। চীন চায় না তাদের দুর্বল হিসেবে হাজির করতে, আবার ট্রাম্পের পিছু হটার অভ্যাস নেই। ফলাফল, বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে এই উত্তেজনা কোন দিকে মোড় নেয়।

সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published.