প্রশান্তি ডেক্স ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে প্রকাশিত ‘ট্রেন্ডস ইন ম্যাটারন্যাল মরটালিটি’ শীর্ষক জাতিসংঘের নতুন বৈশ্বিক প্রতিবেদনে মাতৃমৃত্যু কমার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অগ্রগতির ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এই মাতৃ-স্বাস্থ্যের অগ্রগতি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে প্রধান উন্নয়ন অংশীজনদের স্বঘোষিত ও সম্ভাব্য তহবিল কাটছাঁটের কারণে। গত মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানায় ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ইউনিসেফের রিপ্রেজেন্টেটিভ ওআইসি স্ট্যানলি গোয়াভুয়া জানান, বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। নারীর অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থার উন্নয়ন, সন্তানসম্ভবা মায়েদের জন্য উন্নত জরুরি সেবা নিশ্চিত করা, সন্তান জন্মের সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি বৃদ্ধি, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা এবং পরিবার পরিকল্পনা সম্প্রসারণে সরকারের প্রতিশ্রুতির জন্য অভিনন্দন; এর ফলে মায়েরা এখন নিরাপদে সন্তান প্রসব ও সন্তানদের স্বাস্থ্যকরভাবে গড়ে তুলতে পারছেন। তাছাড়া এসব উদ্যোগে আমাদের উন্নয়ন অংশীজনদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহায়তা ভূমিকা রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, এই সহায়তা কমানো হলে মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নের এই ধারা ধরে রাখার এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভীষ্টসমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বিঘি্নত হতে পারে। অগ্রগতির এই অর্জন ধরে রাখতে স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি বাজেট বরাদ্দ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন, পাশাপাশি প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও সবার জন্য সহজগম্য করা, যাতে নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার খরচ বহন করতে অপারগ মায়েরা জরুরি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না থাকে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০০ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে মাতৃমৃত্যু ৪০ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশের অগ্রগতি কিন্তু এই গড় অর্জনকেও ছাড়িয়ে গেছে – বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার (এমএমআর) ৭৯ শতাংশ কমেছে, প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু ৫২৩ থেকে কমে ১১৫ জনে নেমেছে। এই হিসাবে বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ৪ হাজার মাতৃমৃত্যু ঘটেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে (এএআর) ৭ শতাংশ হারে মাতৃমৃত্যু কমেছে। এই অগ্রগতি অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবাগুলোতে মানুষের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রমাণ তুলে ধরে।
অবশ্য জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যে বৈশ্বিক উদ্বেগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের এসব অর্জন এখন হুমকির মুখে। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে নজিরবিহীনভাবে বিশ্বব্যাপী সহায়তা কমানোর কারণে বিভিন্ন দেশ এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবাসমূহ প্রদানের ক্ষেত্রে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ডা. আহমেদ জামশিদ মোহামেদ বলেন, মাতৃমৃত্যুর ওপর নতুন এই প্রতিবেদনটি আমাদের অগ্রগতি এবং সামনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ উভয়কেই তুলে ধরে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যু ৪০ শতাংশ কমেছে, তবে বিশ্বব্যাপী তহবিল হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশে মানবিক সংকটের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অগ্রগতির যে উদ্বেগজনক ধীরগতি, সেটি আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আমরা মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি, কিন্তু আমরা জানি যে অসমতা এখনও বিদ্যমান, বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও গ্রামীণ পরিবেশে বসবাসকারী নারীদের পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের নারীদের ক্ষেত্রে। আমাদের অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে প্রতিটি নারী, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের সময় তার প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী যত্ন ও সেবার সুযোগ পান। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উন্নয়ন, দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর জনবল তৈরিতে বিনিয়োগ এবং নারীর জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে এমন অন্তর্নিহিত কারণগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশসহ অন্যান্য সব দেশকে সহায়তা করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিরোধযোগ্য মাতৃমৃত্যু নির্মূল করার জন্য সংহতি, বিনিয়োগ এবং টেকসই পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, রক্তপাত, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, অনিরাপদ গর্ভপাত এবং অন্যান্য পরোক্ষ জটিলতা। এসব সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজন উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং প্রয়োজনের সময় জীবন-রক্ষাকারী ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী পাওয়ার সুযোগ। তহবিল কাটছাঁট হলে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসমূহের সেবা প্রদানের সক্ষমতা কমবে, সেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সংখ্যা কমবে এবং অত্যাবশ্যক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘি্নত হবে। আর এসব কিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ ও এর মানের ওপরে।
নিজ খরচে (আউট-অফ-পকেট) চিকিৎসা চালানো, অসহায় ও ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোর জন্য বিশাল এক বাড়তি বোঝা- যা তাদের আরও অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে নিজ পকেট থেকে (আউট-অফ-পকেট) ব্যয় উদ্বেগজনক হারে বেশি, যা স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ-এটি বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই বাড়তি বোঝা প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয় এবং মাতৃত্বকালীন চাহিদা মেটাতে সম্পদহীন মায়েদের ঝুঁকির মুখে ফেলে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়, যার মধ্যে রয়েছে সুসজ্জিত সেবা প্রদান কেন্দ্রগুলো, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের দক্ষ জনবল এবং নির্ভরযোগ্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, রোগ নির্ণয় সেবা ও সামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে যে নাজুক ও জরুরি পরিস্থিতিতে গর্ভধারিণী নারীরা কীভাবে মাতৃমৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন হওয়া সত্ত্বেও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো এখনও অসহায় অবস্থায় রয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, জেন্ডার, আয় এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য (এসআরএইচ) বিষয়ক সেবাসমূহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তহবিল কমলে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে এবং সবচেয়ে অসহায় নারীদের ওপর ব্যাপকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ মাতৃ স্বাস্থ্যে অগ্রগতি উদযাপনের এই সময়ে তহবিল কাটছাঁটের আসন্ন হুমকি এসব অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলছে। গর্ভধারিণী মায়েদের জীবনরক্ষা এবং প্রতিরোধযোগ্য মাতৃমৃত্যু নিরসনের লক্ষ্যে অগ্রগতি অর্জনের এই ধারা অব্যাহত রাখতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের চলমান প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রাখা আবশ্যক।