প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সমর্থন পেতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও বহু দেশ এ নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বাণিজ্যযুদ্ধে নিজ দেশকে একঘরে হতে না দেওয়ার কৌশলের অংশ হিসেবেই শি এ উদ্যোগ নিচ্ছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ বাণিজ্য কর্মকর্তার সঙ্গে ভিডিও বৈঠক করেছেন। টোকিও ও সিউলে নিযুক্ত চীনা কূটনীতিকেরা স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এ সপ্তাহে ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় শি’র রাষ্ট্রীয় সফরের সময় তাকে স্বাগত জানাতে সাজানো জনসমাগম দেখা গেছে।
এই সফরের মাধ্যমে শি এমন এক সময় যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ঐক্য গঠনের চেষ্টা করছেন, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ব্যাপক শুল্ক আরোপ করে চীনা পণ্যের বাজার সংকুচিত করছে। চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়েছে এবং দুষ্প্রাপ্য খনিজ রফতানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে, যা গাড়ি, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মার্কিন নেতৃত্বের ‘অবিশ্বস্ততা’ তুলে ধরছেন শি : ভিয়েতনামে শি একে ‘একতরফা দমননীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে চীন ও ভিয়েতনামকে এর বিরুদ্ধে এক হওয়ার আহ্বান জানান। মালয়েশিয়ায় তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ‘ডিকাপলিং, সাপ্লাই চেইন ব্যাঘাত এবং শুল্কের অপব্যবহার’ প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানান।
ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক লিন কুওক বলেন, চীনা কর্মকর্তারা নিরবে ইউরোপে মার্কিন আচরণকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি হিসেবে উপস্থাপন করছেন। ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি নিজেই সেই বার্তাকে শক্তিশালী করছে।
বিশ্ব নেতাদের সংশয় : তবে শি’র এই উদ্যোগ অনেক দেশের মন জয় করতে পারছে না। চীনের পক্ষ থেকে বিনা শর্তে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার দাবি অতীতে তাদের বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতা ও ভর্তুকিনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ইতোমধ্যে চীনের প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ার গুজব খন্ডন করেছে। ইউরোপের কর্মকর্তারা বরং চীনের ডাম্পিং নীতির বিরুদ্ধেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অস্ট্রেলিয়াও চীনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। চীনা দূত শিয়াও কিয়ানের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার ইঙ্গিত দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
‘মার্কিন দমননীতি’র বিরুদ্ধে চীনের হুঁশিয়ারি : চীনা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক শেন ডিংলি বলেন, যে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিচ্ছে, তারা চীনের ক্ষতি করবে এবং নিজেদেরও ক্ষতির মুখে ফেলবে।
চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভির একটি ব্লগ পোস্টে সরাসরি হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য দেখাতে চীনের স্বার্থকে ত্যাগ করে, চীন তা কখনও মেনে নেবে না।
শি তার ‘গভীর বন্ধুত্বের’ বার্তা দিলেও চীন সম্প্রতি গালফ অব টঙ্কিনে গুলি চালিয়ে সামরিক মহড়া চালিয়েছে, যা দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের দাবি জোরদার করার কৌশল বলেই দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
কেউ যেন ‘চীনবিরোধী জোটে’ না যায় : বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের লক্ষ্য সরাসরি দেশগুলোকে নিজের পক্ষে আনা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ হওয়া ঠেকানো। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো ও সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা জনাথন সিন বলেন, শি জিনপিংয়ের দরকার নেই সবাইকে নিজের পক্ষে আনা, তিনি শুধু চাইছেন কেউ যেন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে না যায়। এ কারণেই চীনের এই ‘আকর্ষণ অভিযান’ এখনও খুব একটা কার্যকর হয়নি।
ভিয়েতনামের কৌশলগত দ্বিধা : ভিয়েতনাম এই সফরে শিকে বিরল সম্মান দিলেও তার বক্তব্যে পুরোপুরি সমর্থন জানায়নি। তারা ‘ক্ষমতানির্ভর রাজনীতি’ বিরোধী একটি সাধারণ বিবৃতিতে সম্মত হয়, যেখানে চীনকেই বহুবার দক্ষিণ চীন সাগরের বিষয়ে ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের’ অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের হুমকি হিসেবে ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের শঙ্কা মাথায় রেখে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনায় অংশ নিয়েছে এবং চীনা পণ্য অবৈধভাবে রফতানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধ ক্রমেই বৈশ্বিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে চীন বিশ্বজুড়ে সমর্থন আদায়ে মরিয়া হলেও দেশগুলোর কৌশলগত সংশয় ও প্রতিশোধের ভয় তাদের চূড়ান্ত অবস্থান নিতে বাধা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একতরফাভাবে সম্পর্ক গড়লে বিপদ, আর চীনের পাশে দাঁড়ালেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জটিলতায় পড়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ববাণিজ্যের এই উত্তপ্ত পরিসরে কোনও দেশই দ্ব্যর্থহীনভাবে পক্ষ নিতে চাইছে না- এটাই এখনকার বাস্তবতা।