শুধু নির্বাচন নয়, অন্তবর্তী সরকারের ম্যান্ডেট তিনটি: লন্ডনে ড. ইউনূস

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ যুক্তরাজ্য সফরের দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যখন চ্যাথাম হাউজ থিঙ্কট্যাঙ্কে তার নির্ধারিত অনুষ্ঠানের জন্য এলেন, তারও বহু আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানের মূল প্রবেশপথের উল্টোদিকে সেন্ট জেমস স্কোয়ারের সামনে  জড়ো হয়ে গিয়েছিল প্রায় শ-দেড়েক মানুষের ভিড়। লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিশের কড়া পাহারার মধ্যেই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু ে¯্লাগান দিয়ে আর লিফলেট বিলি করে তারা পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন। ফলে আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রবেশেও ছিল ব্যাপক কড়াকড়ি, পরিচয়পত্র যাচাই-বাছাই ইত্যাদি।

চ্যাথাম হাউজের ভেতরে মূল অনুষ্ঠানে অবশ্য সেটা কোনও আঁচ ফেলতে পারেনি। ওই থিঙ্কট্যাঙ্কের পরিচালক তথা প্রধান নির্বাহী ব্রনওয়েন ম্যাডক্সের কুশলী সঞ্চালনায় ঘণ্টাখানেকের টানটান অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস প্রায় হাজারখানেক বাছাই করা দর্শক-শ্রোতার সামনে সমকালীন নানা বিষয়ে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন, উত্তরও দিয়েছেন কয়েকটি প্রশ্নের। কয়েকটি ক্ষেত্রে আবার উত্তর এড়িয়েও গেছেন।

বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল বা এমনকি সেনাবাহিনীও যেখানে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইছে, সেখানে কেন তিনি এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করাতে চাইছেন, এদিন লন্ডনে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড. ইউনূস। তবে নির্বাচনের পর নতুন রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব নিলে তিনি যে সেই সরকারে কোনোভাবেই যুক্ত হবেন না, সেটিও জানিয়ে দিয়েছেন। ‘শুধু আমি কেন, আমার মনে হয় না আমার কেবিনেটের কোনও উপদেষ্টাই সেখানে থাকতে চাইবেন’, জানান তিনি।

নির্বাচন আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ প্রায় ১৭ বছর হলো কোনও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেখেনি। দেশের তরুণ প্রজন্ম জানেই না স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করাটা কী জিনিস। আমরা তাদের জীবনে প্রথমবারের মতো সেই স্বাদ দেবো। দেখবেন, আগামী নির্বাচন হবে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে স্মরণকালের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন!’

নির্বাচন আয়োজনে এতটা সময় লাগছে কেন, প্রশ্নে ড. ইউনূস জবাব দেন, ‘আমাদের অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব কিন্তু প্রধানত তিনটা। বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে যে ফ্যাসিবাদী শাসন বছরের পর বছর ধরে চালানো হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক সংস্কার ছাড়া নতুন দেশ গড়া সম্ভব নয়। এ কারণেই আমরা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা কমিশন তৈরি করে সেগুলোর সংস্কারে হাত দিয়েছি। এই সংস্কার বা রিফর্মস হলো আমাদের প্রথম দায়িত্ব।’

‘এরপর দ্বিতীয় দায়িত্ব হলো-ট্রায়াল, যার অর্থ জুলাই গণহত্যা বা তার আগে গুম-নির্যাতন-হত্যাকান্ডের জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। আমরা সেই প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু করেছি। এরপর তৃতীয়টা হলো-সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আয়োজন।’

অর্থাৎ ড. ইউনূস বুঝিয়ে দিয়েছেন, অন্তবর্তী সরকারের ম্যান্ডেট শুধু নির্বাচন আয়োজন করা নয় (যেমনটা অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো করেছে), এখন আগে সংস্কার ও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করার পরই তার সরকার নির্বাচনের কাজে হাত দেবে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যাতে দেশে এনে বিচার করা যায়, তার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক চার্জশিট জমা হলে ভারতের কাছে আবারও আইনি নথিপত্র পাঠিয়ে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হবে, সে কথাও জানিয়েছেন তিনি।

ব্যাংককে গত এপ্রিলে (বিমসটেক সামিটের সাইডলাইনে) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে তিনি যে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, সে কথাও আবার নিশ্চিত করেন ড. ইউনূস।

তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বললাম-আপনারা ওনাকে আশ্রয় দিয়েছেন, সেটি আপনাদের নীতি, সেটাও না হয় বুঝলাম। কিন্তু উনি ওখানে বসে বাংলাদেশের মানুষকে সম্বোধন করে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন বা উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছেন-তাতে আমাদের ওখানে সমস্যা হচ্ছে, আপনারা ওনাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলুন!’

‘‘তো উনি (মোদি) জবাবে বললেন, ‘এটা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগু ওখানে যে কেউ যা খুশি বলতে পারেন, আমরা কীভাবে ওনাকে আটকাতে পারি!’ এটা কী কোনও যুক্তি হলো! এমন একটা বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে কি সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ বললেই  হয়ে গেলো!’’

অন্য একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি এটিও ক্ল্যারিফাই করে জানান, তার সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেনিু শুধু বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রমে রাশ টানা হয়েছে। ‘বিদেশ থেকে তাদের নেতৃত্ব যেভাবে বাংলাদেশের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছিলেন, জুলাই বিপ্লবের কান্ডারিদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলেন, তাতে বাধ্য হয়েই আমাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে’- জানান তিনি।

লন্ডনভিত্তিক লেখক, জিওপলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট ও বাংলাদেশ-গবেষক প্রিয়জিত দেবসরকার এদিন আগাগোড়া এই ইভেন্টটি ফলো করেছেন, তার কাছে জানতে চেয়েছিল ড. ইউনূসের এই বক্তব্য কতটা গুরুত্ব বহন করছে?

মি. দেবসরকার জবাবে বলেন, ‘স্পষ্টতই তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছেন যে দারুণ একটি নির্বাচন আয়োজনের জন্য তার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে কীভাবে একটি উৎসবমুখর ও সুন্দর নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু তার কাছ থেকে আমরা পাইনি।’

‘তা ছাড়া তিনি নিজেই বলেছেন, শেখ হাসিনার অনলাইনে দেওয়া বক্তব্যও বাংলাদেশে অনেকে শুনছেন, তাদের সেটি উদ্দীপিত করছে। এতটাই যে সরকারকেও সেটা বিচলিত করছে। তাহলে তো এটাই ধরে নিতে হয় বাংলাদেশে শেখ হাসিনার এখনও বহু অনুগামী বা সমর্থক আছেন!’

তা ছাড়া তিনি জুলাই গণহত্যার যে বিচারের কথা বলেছেন, সেই ম্যান্ডেট তার সরকারকে কে দিয়েছে, সেটাও স্পষ্ট নয় বলে প্রিয়জিত দেবসরকার মনে করেন।

‘এই কাজটা তো নির্বাচিত সরকার এসেও করতে পারতো। আমাদের সরকারের দায়িত্ব এটার বিচার করা, এ কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই ব্যাখ্যাও কিন্তু তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি!’- বলছিলেন মি দেবসরকার।

এদিনের অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা বড় অংশ উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন লন্ডনের সাংবাদিক-বিশ্লেষক-অ্যাকাডেমিকরাও। ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রেস সচিব শফিকুল আলম, লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম দর্শক আসনের প্রথম সারিতেই ছিলেন।

লন্ডনে স্থানীয় সময় সোয়া ১২টা নাগাদ অনুষ্ঠানের শেষে চ্যাথাম হাউজের বাইরে অল্প কিছু ইউনূস সমর্থকও ততক্ষণে জুটে গেছেন-‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটি কোয়ালিশনে’র ব্যানারে তারা ে¯্লাগান দিচ্ছিলেন নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টার নামে।

ওদিকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যারা সকাল থেকে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, পুলিশ তাদের ততক্ষণে সরিয়ে দিয়েছে। সেন্ট জেমস স্কোয়ারের সামনের দুপুরের রাস্তা আবারও সুনসান!

Leave a Reply

Your email address will not be published.