২০আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৭৪শতাংশ ঋণের নেই কোনও জামানত

প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশের ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক খাতে (এনবিএফআই) গুরুতর সংকট প্রকাশ পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০টি সমস্যাগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা মাত্র ২৬ শতাংশ ঋণের বিপরীতে জামানত আছে। অর্থাৎ বিতরণ করা মাত্র ৬৮৯৯ কোটি টাকা নিরাপদ। ধারণা করা হচ্ছে, শুধু এই ঋণের টাকা সম্ভাব্যভাবে ফেরত পাওয়া যেতে পারে। বাকি বিতরণ করা ৭৪ শতাংশ ঋণের কোনও জামানত নেই। অর্থাৎ বড় অঙ্কের এই ঋণ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত, যা আমানতকারীদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, করুণ দশায় পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭টির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৫ থেকে প্রায় শতভাগ। আর সাড়ে ৫২ থেকে প্রায় ৮৩ শতাংশের বোঝা টানছে আরও ১৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২১,৪৬২ কোটি টাকা যা ঋণপোর্টফোলিও’র ৮৩ শতাংশের বেশি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে পড়ছে। এমনকি আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না।

এই অবস্থা অর্থ কেবল সমস্যাগস্ত প্রতিষ্ঠানের নয় বরং পুরো এনবিএফআই খাতের ওপর আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টিকে অবসায়নের (লিকুইডেশন) সুপারিশ করা হয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন ছাড়া তারা ধীরে ধীরে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

ঋণ বনাম জামানত: ভয়ংকর চিত্র

২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা মোট ঋণ ছিল ২৫,৮০৮ কোটি টাকা, কিন্তু জামানত ছিল মাত্র ৬,৮৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশই জামানত দ্বারা সুরক্ষিত।

এদিকে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২১,৪৬২ কোটি টাকা, যা ঋণপোর্টফোলিও’র ৮৩ শতাংশের বেশি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তরলতা সংকটে পড়ে, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

এই প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ২২,১২৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ১৬,৩৬৭ কোটি এবং ব্যক্তি আমানত ৫,৭৬০ কোটি টাকা। নিরাপদ জামানতের তুলনায় এই অমিলই প্রধান সমস্যা সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, গত বছরের শেষে ১২টি এনবিএফআইয়ের হাতে পুরো খাতের ৭৩.৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত ছিল। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে ‘রেড ক্যাটাগরিতে’ রাখা হয়। জানুয়ারিতে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি পাঠিয়ে জবাবদিহি চাইলে ৯টির ব্যাখ্যা অসন্তোষজনক হওয়ায় তাদের লিকুইডেশনের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এই সিদ্ধান্ত এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ৯টি এনবিএফআই লিকুইডেশন শুধু সংকটাপন্ন প্রতিষ্ঠানের পতন নয়, বরং এতে গোটা খাতের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের সূচনা হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষে এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি বহন করছে ৯টি প্রতিষ্ঠান।

সমস্যার মূল কারণ

বিশ্লেষণে উঠে এসেছে প্রধান চারটি কারণ পরিচিত পক্ষের ঋণ প্রদানের প্রবণতা: প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও গোষ্ঠীর কাছে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

জামানতের অস্বচ্ছ হিসাব: বহু প্রতিষ্ঠান নিজেরাই জামানতের মান ঘোষণা করে। স্বাধীন যাচাই বা নিরীক্ষা নেই।

তদারকির ঘাটতি: দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি কার্যকর হয়নি, ফলে অনিয়ম বেড়ে গেছে।

ঋণ আদায়ে ব্যর্থতা: দীর্ঘসূত্রতা ও অনিয়মিত পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি করেছে।

নেতৃত্ব সংকটে প্রতিষ্ঠানগুলো

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো চিহ্নিত অনেক এনবিএফআই বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াই চলছে। কিছু প্রতিষ্ঠান স্বাধীন পরিচালক দিয়ে পরিচালিত হলেও কার্যত কোনও ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই। বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে তারা অচল অবস্থায় রয়েছে।

কোন প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় আছে?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র অনুযায়ী চিহ্নিত ২০টি প্রতিষ্ঠান হলো সি.ভি.সি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, জি.এস.পি ফাইন্যান্স, হাজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আই.আই.ডি.এফ.সি, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, উত্তরা ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স এবং এফ.এ.এস ফাইন্যান্স।

এর মধ্যে এফ.এ.এস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জি.এস.পি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এই ৯টি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের তালিকায় রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সংকট হঠাৎ তৈরি হয়নি। এটা মূলত দীর্ঘদিনের দুর্বল তদারকি, অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফল। এখন প্রশ্ন হলো খাতকে পুনঃস্থাপন করা সম্ভব কিনা, নাকি অবসায়নই একমাত্র সমাধান।

কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত?

আমানতকারী: ছোট-বড় সব আমানতকারীই ঝুঁকিতে আছেন। নিরাপদ জামানত সীমিত হওয়ায় সবার টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত।

অন্য প্রতিষ্ঠান: সংকট কেবল সমস্যাগস্ত প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়। ভালো অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের ওপরও আস্থা কমছে।

সরকারি ব্যয়: পুনর্গঠন বা অবসায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে ৯ হাজার কোটি টাকা সরকারি তহবিল প্রয়োজন হতে পারে।

নিয়ন্ত্রকের অবস্থান: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য আমানতকারীর স্বার্থ সুরক্ষা। যা ফেরত দেওয়া সম্ভব, তা আইনি ও আর্থিক উপায়ে আদায় করা হবে। বাকিগুলোতে অবসায়ন বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চালানো হবে।”

করণীয় ও পরবর্তী পদক্ষেপ

বিশ্লেষকরা বলছেন স্বাধীন সম্পদ যাচাই করে প্রকৃত সম্পদ-মান নির্ধারণ করতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ এবং সম্পদ জব্দ করতে হবে। ক্ষতিগস্তদের আংশিক ফেরত নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা জরুরি। নিয়ন্ত্রক তত্ত্বাবধান শক্ত করা এবং আর্থিক তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা দরকার। অনিয়মে জড়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংক খাতে নতুন লাইসেন্স দেওয়ার সুযোগ না থাকায় বিকল্প হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স চালু করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির কারণে এখান থেকেও বিপুল অর্থ তছরুপ হয়েছে।’ তার মতে, মূলধন ও দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে রক্ষায় সক্ষম এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রাখা যেতে পারে। তবে অনিয়মে জড়িত ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক্সিট পলিসির আওতায় এনে বাজার থেকে সরিয়ে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published.