পরীক্ষা না নিয়েই ‘গুণী শিক্ষক’ নির্বাচন?   

প্রশান্তি ডেক্স ॥ ঢাকা বিভাগের সব জেলা থেকে ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ এবং ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ ক্যাটাগরিতে নির্বাচিতদের বিভাগীয় পর্যায়ে বাছাইয়ের জন্য ভাইবা আহ্বান করে ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালকের দফতর। গত রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) ছিল বাছাইয়ের নির্ধারিত দিন। কিন্তু তার আগেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর মাত্র চারটি জেলার ভাইবা নিয়ে ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ এবং ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ মনোনয়ন দিয়ে পাঠানো হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে।

ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক কার্যালয়ের ১৮ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিভাগের প্রাথমিক (সাধারণ) বিদ্যালয় পর্যায়ে গুণী শিক্ষক নির্বাচন আগামী ২১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়, সেগুনবাগিচায় অনুষ্ঠিত হবে। বাছাই প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত গুণী শিক্ষককে যথাসময়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করা হলো।’

কিন্তু অভিযোগ ওঠে, বাছাই প্রতিযোগিতার নির্ধারিত দিনের আগেই ঢাকা জেলাসহ কয়েকটি জেলা বাদ দিয়ে মাত্র চারটি জেলার শিক্ষকদের অনলাইনে ভাইবা নিয়ে ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ এবং ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ হিসেবে বাছাই করে তালিকা পাঠানো হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাছাইয়ের জন্য নির্ধারিত দিন ২১ সেপ্টেম্বর হলেও তার আগেই ১৮ সেপ্টেম্বর অনলাইনে ভাইবা নেওয়া হয় চার জেলার প্রার্থীদের। বাকিদের ভাইবা নেওয়া হয়নি, এমনকি জেলা থেকে নির্বাচিত প্রার্থীদের তা চিঠি দিয়ে জানানোও হয়নি।

ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় থেকে নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে জেলা পর্যায়ে সেরা ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ ও ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ নির্বাচন করে গত ১৪ সেপ্টেম্বর অধিদফতরে পাঠানো হয়।

১৪ সেপ্টেম্বরের চিঠি

ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসের গত ১৪ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে দেখা যায়, জেলা পর্যায়ে ঢাকার ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হন সাভারের হেমায়েতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহীদা এমরানী। আর ‘সহকারী শিক্ষক’ ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হন ঢাকা সেনানিবাসের ইব্রাহিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আফরোজা পারভিন। এই দুই শিক্ষক ঢাকা বিভাগীয় বাছাই পর্বের ভাইবায় অংশ নিতে পারেননি।

জানতে চাইলে ঢাকা জেলা পর্যায়ে ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ ক্যাটাগরিতে সেরা নির্বাচিত সাভারের হেমায়েতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহীদা এমরানী বলেন, ‘২১ সেপ্টেম্বর আমাদের ভাইবা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল।’ সেদিন ভাইবা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর আগে গত (১৮ সেপ্টেম্বর) হোয়াটসঅ্যাপে অনলাইনে স্কুল ভিজিট করছেন।’ নির্ধারিত দিন ভাইবায় অংশ নিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘ওইটাই নাকি ভাইবা, হোয়াটসঅ্যাপে যেটা হয়েছিল। ২১ সেপ্টেম্বরের পরীক্ষা নাকি স্থগিত করেছে। সরাসরি ভাইবা হয়নি।’

ঢাকা জেলা পর্যায়ে ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ ক্যাটাগরিতে সেরা নির্বাচিত ঢাকা সেনানিবাসের ইব্রাহিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আফরোজা পারভিন বলেন, ‘বিভাগীয় পর্যায়ের বাছাইয়ের জন্য ভাইবা ছিল ২১ সেপ্টেম্বর। ওই দিন জানতে পারি ১৮ সেপ্টেম্বর বাছাই হয়ে গেছে। ঢাকা জেলার ভাইবা নেওয়া হয়নি।’

ঢাকা জেলার নির্বাচিত প্রার্থীদের ভাইবা না নিয়েই কীভাবে বিভাগীয় প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো জানি না। জেলা থেকে ভাইবার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হলেও ঢাকা জেলার ভাইবা ছাড়াই বিভাগীয় বাছাই শেষ করা হয়েছে।’

১৮ সেপ্টেম্বরের চিঠি

বিভাগীয় উপ-পরিচালক আলী রেজার সই করা ১৮ সেপ্টেম্বরের চিঠির সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ ক্যাটাগরিতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার ভট্টপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বি আর বিলকিস এবং ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ ক্যাটাগরিতে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মর্জিনা আক্তারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

গুণী শিক্ষক নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলে গত রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, ‘১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিভাগের রেজাল্ট হয়েছে। আমরা সেদিনই রেজাল্ট হাতে পেয়েছি এবং নোটিশ করেছি। ২১ সেপ্টেম্বর তাদের ভাইবা হয়েছে এবং আমরা চূড়ান্ত করেছি। অন্যান্য বিভাগ থেকে আগেই ফল পাওয়া গেছে।’

মহাপরিচালকের বক্তব্য এবং অধিদফতরের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, অনিয়মের বিষয়ে অধিদফতর কিছুই জানে না। বিভাগীয় পর্যায়ের সেরাদের নিয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতীয় পর্যায়ের বাছাই সম্পন্ন করা হয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে সেরা ‘গুণী প্রধান শিক্ষক’ নির্বাচিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার ভট্টপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বি আর বিলকিস। আর ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ হয়েছেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার আমলীতলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আয়েশা সিদ্দিকা এবং রাঙামাটি সদর উপজেলার শাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আফফাত জাহান।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রবিবার ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক আলী রেজার অফিসে গেলে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলেন।

গত সোমবার উপ-পরিচালক অফিসের শিক্ষা অফিসার শারমিন নাসিমা বানু ফোন দিয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমরা অনলাইনে ভাইবা নিয়েছি সঠিক পদ্ধতিতে। আমাদের বলা ছিল পরামর্শ করতে হবে বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে। আমরা কমিশনার মহোদয়কে বলেছি শর্টলিস্টিং হবে। প্রয়োজনে তাদের ভাইবা নেন। তখন স্যার (বিভাগীয় কমিশনার) বললেন, না সবাইকে ডাকেন। আমি আবার ভাইবা নেবো। তিনি আবার বললেন, সময় নেই। আমাদের আজকের মধ্যেই চূড়ান্ত করে দিতে হবে। তালিকা দেন, আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। আমি ওদের ইন্টারভিই নিই। পরে উনি চার জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। উনি রিকমেন্ড করেছেন, আমরা ডিজি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি ১৩ জেলারই ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সময়ের অভাবে চার জনের ইন্টারভিউ নিয়েছেন। আমাদের সবার গ্রুপ আছে, আমরা সবাইকে জানিয়েছি এটা (ইন্টারভিউয়ের চিঠি বাতিল) হয়ে গেছে, আপনারা শিক্ষকদের জানিয়ে দেন। আমরা শিক্ষকদের নিজ নামে চিঠি দেইনি। উপজেলা ও জেলাকে দিয়েছি। অনিবার্য কারণবশত এটা বাতিল হয়ে গেছে। বিষয়টি এরকম, অন্য কিছু নয়। কেউ হয়তো গুণী শিক্ষক হতে পারেননি, সে কারণে আপনাকে বলেছেন। এবার হয়নি, আগামীবার হবে। আমাদের প্রসেসে ভুল ছিল না, সময়ের অভাব ছিল, তাড়াহুড়ো ছিল।’

২১ সেপ্টেম্বরের চিঠি

গুণী শিক্ষক নির্বাচন : শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে নম্বর অর্জনের মাধ্যমে ক্লাস্টার পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা বা থানা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে তার কাজ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অবদানগুলো বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। বিচারকরা একজন প্রধান শিক্ষক এবং একজন সহকারী শিক্ষককে সেরা গুণী শিক্ষক নির্বাচিত করেন।

কেন গুণী শিক্ষক নির্বাচন

২০২৪ সালের ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ উদযাপন নীতিমালায় জানানো হয়, জাতি গঠনে শিক্ষকের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের সম্মাননা জানানোর মাধ্যমে সব শিক্ষককে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ উদযাপন করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো।

শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে সম্মাননা একজন শিক্ষকের জন্য পরম পাওয়া। কাজের স্বীকৃতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ বাড়িয়ে দেয়। শিক্ষকের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সেবা পায়। একজন সহকর্মীর সাফল্যে অন্যজন উদ্বুদ্ধ হয়ে তার কর্মক্ষেত্রে যথাসাধ্য কাজ করার চেষ্টা করেন। এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.