ব্রিটেনে সংকটে জীবনযাত্রার মান

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ অভিবাসীদের একসময়ের স্বপ্নের দেশ  যুক্তরাজ্যে এখন জীবনযাত্রার মান স্মরনকালের সংকটে রয়েছে। স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট নিয়ে দিন কাটছে সদ্য আসা অভিবাসীদের।

ব্রিটেনের ইতিহাসে এই প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটল, যেখানে একটি পার্লামেন্টারি মেয়াদের শুরুতে একজন সাধারণ মানুষের খরচযোগ্য গড় আয় যা ছিল, মেয়াদের শেষে তা কমে গেছে।

খরচযোগ্য আয় বলতে বোঝায় কর এবং সরকারি সুবিধার পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে, যা দিয়ে একজন ব্যক্তিকে ভাড়া, বিদ্যুৎ, এবং খাবারের মতো অত্যাবশ্যকীয় খরচ মেটাতে হয়।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কনজারভেটিভ সরকারের নির্বাচনি জয় এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তাদের পরাজয়ের মধ্যবর্তী সময়ে, প্রতি ব্যক্তির মাসিক খরচযোগ্য আয় ৪০ পাউন্ড কমে গেছে। এই পতন একজন সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিকের সাপ্তাহিক খাবার ও পানীয়ের খরচের প্রায় সমতুল্য।

১৯৫৫ সাল থেকে, সাধারণত প্রতি পার্লামেন্টারি মেয়াদে জীবনযাত্রার মান গড়ে প্রতি মাসে ১১৫ পাউন্ড করে উন্নত হতো। জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে এই নজিরবিহীন ব্যর্থতা বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণের এক ‘পারফেক্ট স্টর্ম’-এর ফল, যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করেছে।

পতনের মূল কারণসমূহ : বৈশ্বিক ধাক্কা ও মুদ্রাস্ফীতি: প্রধান চালক ছিল কোভিড-১৯ মহামারি এবং এর ফলস্বরূপ এক প্রজন্মের মধ্যে দেখা দেওয়া সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে আরও তীব্র হয়। এই বৈশ্বিক ধাক্কাগুলো অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের খরচকে আকাশচুম্বী করে তোলে।

অত্যাবশ্যকীয় খরচের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি: ২০১৯ সাল থেকে জ্বালানি, খাদ্য ও আবাসন এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার দাম সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও দ্রুত গতিতে বেড়েছে। এর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কারণ তাদের আয়ের একটি বড় অংশ এসব প্রয়োজনীয় জিনিসে খরচ করতে হয়। এতে তাদের সঞ্চয় বা অন্যান্য খাতে খরচ করার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নীতি ও অস্থিরতা: কনজারভেটিভ সরকারের মেয়াদে ঘন ঘন নেতৃত্ব পরিবর্তন ও নীতির দিকবদলসহ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্রেক্সিটের চলমান অর্থনৈতিক প্রভাব (যেমন ‘রেড টেপ’ বৃদ্ধি ও শ্রমিকের ঘাটতি) এমন এক অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যা বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করেছে। ফলস্বরূপ, অন্যান্য তুলনামূলক দেশের তুলনায় ব্রিটেনের প্রবৃদ্ধির হার দুর্বল হয়েছে।

বেতন বৃদ্ধিতে স্থবিরতা: এই সময়ের বেশিরভাগ জুড়েই বেতন ও সুবিধার মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় আকাশছোঁয়া দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি, যার ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।

জোসেফ রনট্রি ফাউন্ডেশনের আবাসন খরচসহ বিশ্লেষণের পূর্বাভাস অনুযায়ী, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় খরচযোগ্য আয় যা ছিল, ২০২৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা মাসে আরও ৪৫ পাউন্ড কম থাকতে পারে। এটি প্রকৃত আয়ের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য এক দশকব্যাপী স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত নতুন অভিবাসীরা এ পরিস্থিতিতে হতাশ।

পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের পথ: – ‘ভাল’ জীবনযাত্রার মানে ফিরে আসার সুযোগ অর্থাৎ, প্রকৃত আয়ের ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির ঐতিহাসিক প্রবণতায় ফেরা নির্ভর করছে বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দ্রুত প্রত্যাবর্তনের উপর।

বর্তমান গতিপথ: নতুন সরকার তার প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪) খরচযোগ্য আয়ে প্রাথমিক উন্নতি দেখেছিল, যা আংশিকভাবে পূর্বে-সম্মত সরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধির কারণে ঘটেছিল। তবে, এটি একটি নিহিত অবনতিকে আড়াল করে, কারণ খরচযোগ্য আয় এখন ২০২৫ সালের শুরুর চেয়েও কম। এটি ইঙ্গিত দেয় যে নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির মৌলিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

সময়সীমা: অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে বর্তমান মন্দা পুষিয়ে নিতে ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে একটি অর্থবহ ‘ধরে ফেলার বুস্ট’ প্রয়োজন হবে। তবে, পূর্বাভাসগুলো এখনও পরিমিত। ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৯-৩০ পর্যন্ত প্রকৃত পারিবারিক খরচযোগ্য আয় প্রতি বছর গড়ে মাত্র আধা শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বর্তমান নেতিবাচক প্রবণতা বজায় থাকলে, যুক্তরাজ্য নথিবদ্ধ সময়কালের মধ্যে জীবনযাত্রার মানের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে পরপর দুটি সবচেয়ে খারাপ সংসদীয় মেয়াদের সম্মুখীন হতে পারে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা: রাজনৈতিক অস্থিরতা সরাসরি অর্থনৈতিক আস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার উপর প্রভাব ফেলেছে। ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্পষ্ট কৌশলের অভাব এবং একটি কঠিন আর্থিক পরিবেশ (উচ্চ ঋণ ও সুদের হার) দুর্বল উৎপাদনশীলতার দিকে পরিচালিত করেছে। নিম্ন প্রবৃদ্ধি এবং প্রকৃত আয়ের পতনের এই চক্র ভাংতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার (যেমন বিনিয়োগ, শিক্ষা ও পরিকল্পনা খাতে) বাস্তবায়নের জন্য টেকসই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হিসাবে দেখা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে যুক্তরাজ্যে  ব্রিটিশ বাংলাদেশী ব্যবসায়ী সংগঠন চেম্বার অব কমাসের্র অন্যতম শীর্ষনেতা ও জেএমজি কার্গোর কর্নধার মনির আহমদ গত বৃহম্পতিবার বলেন, একটি উল্লেখযোগ্য এবং টেকসই পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থনৈতিক গতিপথে একটি মৌলিক পরিবর্তন দরকার, যা দীর্ঘমেয়াদী নীতিগত অঙ্গীকার এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সমাপ্তির মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে বলে আমরা আশা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.