প্রশান্তি ডেক্স ॥ বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ও শিল্প প্রবৃদ্ধি ক্রমেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ঘিরে। সম্প্রতি এই প্রবৃদ্ধির ধারায় রংপুর শহরও যুক্ত হয়েছে। ফলে গঠিত হয়েছে এক ধরনের ‘ত্রিশূল আকৃতির প্রবৃদ্ধি করিডর’ এমন চিত্র ফুটে উঠেছে বিশ্বব্যাংকের ৭ অক্টোবর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট আপডেট-২০২৫’ প্রতিবেদনে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান, জনসংখ্যা ও অবকাঠামো উন্নয়নের ভৌগোলিক বিন্যাসে বড় পরিবর্তন এসেছে। এর পেছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে উৎপাদনশীল খাত; বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণ।
তবে এই শিল্পায়ন হয়েছে প্রায় পরিকল্পনাহীনভাবে যা একদিকে দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে গতি এনেছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক বৈষম্য ও নগরায়ণের ভারসাম্যহীনতা বাড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
ঢাকাচট্টগ্রাম করিডর সবচেয়ে গতিশীল
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় অঞ্চল এখন ঢাকাচট্টগ্রাম করিডর। এখানেই দেশের অধিকাংশ বড় শিল্প কারখানা ও উচ্চ উৎপাদনশীল চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পের বিস্তার এই করিডরকে দেশের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে এই করিডরের প্রবৃদ্ধি দক্ষিণে কক্সবাজার ও উত্তরে সিলেট,ময়মনসিংহ,রংপুর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক ভূচিত্রে একটি ‘ত্রিশূল আকৃতি’ গঠিত হয়েছে, যার তিনটি শাখা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরের দিকে প্রসারিত।
রংপুরের উত্থান ও নতুন শিল্পাঞ্চল
রংপুর নগরীর আশপাশে নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে, যা উত্তরাঞ্চলের কর্মসংস্থানে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। একইভাবে নরসিংদী-মাধবদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নোয়াখালী এই তিনটি শহর তাদের কৌশলগত অবস্থান এবং সড়ক সংযোগের কারণে দ্রুত শিল্পায়িত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, মেঘনা নদীর পূর্ব তীরে নরসিংদী-মাধবদী এলাকায় বিগত এক দশকে অনেক বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পে।
‘পূর্বপশ্চিম বৈষম্য’ আরও প্রকট
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিল্পায়ন মূলত দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে সীমাবদ্ধ থাকায় একটি ‘পূর্বপশ্চিম বিভাজন’ তৈরি হয়েছে। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা, যশোর, বরিশাল অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তুলনামূলকভাবে সীমিত রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংক এই বৈষম্যকে ‘আঞ্চলিক কল্যাণ ব্যবধান’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং বলেছে এটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে।
অপর্যাপ্ত পরিকল্পনা ও দুর্বল স্থানীয় সরকার
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের বাস্তব প্রবণতা এবং সরকারি নগর পরিকল্পনার মধ্যে একটি বড় নীতিগত অমিল (পলিসি মিসম্যাচ) তৈরি হয়েছে।
একে বিশ্বব্যাংক ‘একটি বড় নীতিগত অন্ধ বিন্দু (মেজর পলিসি ব্লাইন্ড স্পট)’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
সংস্থাটির মতে, স্থানীয় সরকারগুলো পর্যাপ্ত আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতা না থাকায় তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বা অবকাঠামো উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
নীতি পরামর্শ
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সাফল্য নির্ভর করবে কেবল প্রবৃদ্ধির হার নয়, বরং সেই প্রবৃদ্ধি কতটা আঞ্চলিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে তার ওপর।
সংস্থাটির পরামর্শ হলো স্থানভিত্তিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ জোরদার করা, স্থানীয় সরকারকে আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে শক্তিশালী করা, এবং ভৌগোলিক বৈষম্য কমাতে নীতিগত সমন্বয় বাড়ানো।
প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাফল্য নির্ভর করবে কেবল প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নয়, বরং সেই প্রবৃদ্ধি কীভাবে নারী ও তরুণ জনগোষ্ঠীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, তার ওপর।’