কোন প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত হলো জুলাই জাতীয় সনদ

প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের পর চূড়ান্ত হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। সব পক্ষের সইয়ের পর অনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে এই সনদ। গত শুক্রবার (১৭ জুলাই) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর উপলক্ষে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করবেন।

নিবন্ধিত ৫৬টি দলের মধ্যে ২১টি ও কয়েকটি অনিবন্ধিতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা প্রায় ৮ মাসের ধারাবাহিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে আদর্শগত মতবিরোধ রয়েছে। অনেক সময় দলগুলোর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। ওয়াকআউটের ঘটনাও ঘটেছে। তারপরও বৃহত্তর স্বার্থে দিনের পর দিন এক ছাদের নিচে এবং পাশাপাশি বসে তারা কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, ‘আমাদের মধ্যে চিন্তা চেতনার জায়গায় অনেক অমিল থাকলেও দেশের মানুষের প্রত্যাশাকে সামনে রেখে একসঙ্গে বসেছি। সব পক্ষের অংশগ্রহণের একটি পূর্ণাঙ্গ সনদ বাস্তবায়ন হলে এটি জাতির জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।’

এত কিছুর পরও শেষ মুহূর্তেও দলগুলোর মতবিরোধ রয়েই গেছে। বিশেষ করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও একমত হতে পারেনি দলগুলো। একপক্ষ বলছে, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। আরেক পক্ষের মতামত নির্বাচনের দিনে আলাদা ব্যালটে গণভোট দিতে হবে। কেউ কেউ রাজপথেই এর ফয়সালা দেখতে চান।

এমন বস্ত—বতায় সর্বশেষ গত বুধবার (১৫ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে অতি জরুরি বৈঠকে বসেন কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখান থেকে বের হয়েও নিজেদের দাবির প্রতি অনড় অবস্থানের কথা জানান কয়েকটি দলের নেতারা। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।

মূলত জুলাইয়ের পক্ষের দলগুলোকেই এতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ তাদের সমমনা ১৪ দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অবশ্য বিগত সরকারের সহযোগী নয়, নিবন্ধিত এমন বেশ কিছু দলকেও ডাকা  হয়নি বলে অভিযোগ আছে।

এর আগে গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে সনদের ভাষ্য দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে কমিশন। তবে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে বেশির ভাগের বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো। কিছু বিষয়ে ভিন্নমত, আবার কয়েকটিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে একমত হয়েছে। সেসব মত-দ্বিমতের বিষয়গুলো রেখেই সনদ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশ

সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মোটা দাগে ৬টি সুপারিশ পেয়েছিল কমিশন। সেগুলো হলো পূর্ণাঙ্গ সনদ বা তার কিছু অংশ নিয়ে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে, গণপরিষদ গঠন বা ত্রয়োদশ সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে এই মর্মে মতামত চাওয়া যে অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে কমিশন। এরই মধ্যে কমিশনের দ্বিতীয় দফা মেয়াদ শেষ হয় ১৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন রাতেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়। যা বলবৎ থাকার কথা ছিল চলতি মাসের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। সর্বশেষ ৯ অক্টোবরের বৈঠকে জানানো হয়, ১৫ অক্টোবর সনদে সই করবে দলগুলো। অবশ্য পরে ১৭ অক্টোবর এ আয়োজনের কথা জানায় কমিশন।

কোন প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত হলো?

জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য অনুযায়ী ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অনেক বিষয়ে একমত হয়েছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল।

তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়েছে কোনও কোনও দল। সেগুলো যুক্ত করা হয়েছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ।

তবে, এই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেই বিষয়ে আলাদা করে কোনেও সুপারিশ করেনি কমিশন।

যদিও জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনও ধরনের কালক্ষেপণ না করে দ্রুত সময়েই বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তী সরকার।

সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে ৪৭টি সিদ্ধান্ত, যেগুলো বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। পরের ভাগে ৩৭টি সিদ্ধান্ত, সেগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। যদিও এখনও সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে একমত হতে পারেনি দলগুলো।

সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবরের বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছিলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কিংবা পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনও সুপারিশ করা হয়নি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিশনের এক সদস্য বলেন, ‘‘দলগুলোকে একটি সিদ্ধান্তে আনার ক্ষেত্রে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। মূলত এ কারণেই বারবার সময় বাড়ানো হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’’

বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, ‘‘সব দলের মত-দ্বিমতের মধ্য দিয়েই একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আমরা মনে করি, সিদ্ধান্ত মানা না মানার অধিকার সব দলেরই আছে। কিন্তু শেষ সময়ে যারা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা মূলত নির্বাচন ঠেকানোর লক্ষ্যে এমনটি করছেন।’’ এ ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট সক্রিয় কাজ করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ওয়াকআউট বর্জন

গত ২৮ জুলাই কমিশনের বৈঠকের শুরুতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব রক্ষকের কার্যালয় এবং ন্যায়পাল নিয়োগের জন্য পৃথক ও স্বচ্ছ নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাব ইস্যুতে আলোচনা শুরু হয়। এসব বিষয়ে একমত না হওয়ায় বৈঠকে থেকে ১০ মিনিটের জন্য ওয়াকআউট করেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর প্রতিনিধিরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ তখন সাংবাদিকদের জানান, কমিশন আমাদের মতামত উপেক্ষা করে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে, তাই সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি আবারও যোগ দেন।

দ্বিতীয় ধাপের বৈঠকের শেষ মুহূর্তে ৩১ জুলাই রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক থেকে বের হয়ে যান চার বাম দলের নেতারা। মূলত বাহাত্তরের সংবিধান থেকে চার মূলনীতি বাদ দেওয়া প্রশ্নে এ সিদ্ধান্ত নেয় দলগুলো। তাদের মতে, এটি মুক্তিযুদ্ধের সনদ। এর বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা।

সভা বর্জনকারী দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয়  সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। যদিও তৃতীয় ধাপে তারা আবার যোগদান করেন।

এর আগে ১৭ জুন কমিশনের বৈঠকে যোগ দেয়নি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ বিষয়ে পরদিন সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা দেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি জানান, মূলত লন্ডনে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করায় তারা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। তাই এ সিদ্ধান্ত। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে তারা আবার যোগ দিয়েছেন।

শুরু শেষ যেভাবে

জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষায় বিদ্যমান সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। প্রথম দফায় ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। ১০ মার্চ প্রথমে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু হয়। প্রথম দফায় শুধু একটি একটি করে দল অংশগ্রহণ করে। ১৯ মে এ ধাপের বৈঠক শেষ হয়।

পরবর্তীকালে জুনের প্রথম সপ্তাহে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ধাপের ২৩ কার্য দিবসের আলোচনা শেষ হয় ৩১ জুলাই।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দুই ধাপের সংলাপের ভিত্তিতে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য তৈরি করে কমিশন। এরপর সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর তৃতীয় ধাপের বৈঠক শুরু করে কমিশন।

এরই মধ্যে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব তুলে ধরেছিল কমিশন। সে প্রস্তাবে বলা হয়, মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। এরপর আদেশটি নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে গণভোট করা যেতে পারে।

সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবর গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি ঐকমত্য পোষণ করে। সেক্ষেত্রে গণভোট জাতীয়  নির্বাচনের আগে হবে না ভোটের দিন হবে, তা নিয়ে মতানৈক্য হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.