নারীদের ৫ঘণ্টা চাকরির ঘোষণায় খুশি না কেন ?

প্রশান্তি ডেক্স॥ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ক্ষমতায় গেলে নারীদের কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৫ ঘণ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অথচ তার এই ঘোষণায় খুশি হতে পারছেন না নারীরা। তারা বলছেন, যদি নারীদের কর্মঘণ্টা পুরুষদের তুলনায় কম (যেমন ৫ ঘণ্টা বনাম ৮ ঘণ্টা) নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তাদের পেশাগত জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তারা মনে করছেন, বড় কোনও পদের উপযোগী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হতে হবে এবং একসময় হতাশা থেকে চাকরি ছেড়ে দিতে হতে পারে। আর নারী নেত্রীরা বলছেন, নারীকে ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতার মাঠ থেকে সরিয়ে দিতেই এরকম পরিকল্পনা করা সম্ভব। এসব না করে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে তৈরি করার কথা, সেটা নিশ্চিত করার ঘোষণা দিক।

নিউ ইয়র্ক সিটির এস্টোরিয়া ওয়ার্ল্ড মেনারে ‘কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘‘একজন মা সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, লালন-পালন করছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে পেশাজীবী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। পুরুষ ৮ ঘণ্টা কাজ করলে নারীরও সমান সময় দেওয়া কি ন্যায্য? আমরা ক্ষমতায় এলে তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে ৫ ঘণ্টা করবো, যাতে মা হিসেবে তারা সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেন।’’

তার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নারী নেত্রীরা বলছেন, এ ধরনের কোনও উদ্যাগকে তারা স্বাগত জানাবেন না। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে অসাম্য তৈরি হবে। নিয়োগকর্তারা ভাবতে পারেন যে নারীরা কম সময় কাজ করেন, তাই তাদের দায়িত্ব বা পদ কম দেওয়া উচিত। ফলে নারী কর্মীরা তুলনামূলক কম সুযোগ, কম পদোন্নতি বা কম বেতন পেতে পারেন। বরং নারীর জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার বাধ্যতামূলক করা, যৌন হয়রানি রোধে নীতিমালা নিশ্চিত করা, সদ্য মা-বাবাদের জন্য নমনীয় কর্মঘণ্টা নিয়ে ভাবা জরুরি। তা না করে ৫ ঘণ্টা বেঁধে দিয়ে তার কাজের জায়গা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করবেন না

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪’ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ১২১.৮ মিলিয়ন কর্মক্ষম বয়সের মানুষ রয়েছে, যাদের মধ্যে ৭১.৭ মিলিয়ন সক্রিয়ভাবে শ্রমবাজারে যুক্ত। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। অর্থাৎ মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এক দশক আগে এই অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ২৭ শতাংশ। এখন তা প্রায় ৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবু পুরুষদের অংশগ্রহণের হার এখনও ৮০-৮৫ শতাংশ। ফলে এটা পরিষ্কার যে কর্মক্ষম নারীদের অর্ধেকেরও বেশি এখনও শ্রমবাজারের বাইরে রয়ে গেছে। দেশে পোশাক কারখানায় কর্মরত মোট শ্রমিক প্রায় ৫০.১৭ লাখ। এদের মধ্যে নারী শ্রমিকের অংশ প্রায় ৫৫.৫৭ শতাংশ, যা প্রায় ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৬ জন। আবার নারীরা প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ব্যয় করেন গৃহস্থালি কাজ, সন্তান লালন-পালন ও বয়স্কদের যত্নে, যেখানে পুরুষরা ব্যয় করেন মাত্র ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট।

নারীর কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা থেকে ৫ ঘণ্টায় নামানোর মধ্য দিয়ে সমতা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত লঙ্ঘন করা হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, ‘‘৮ ঘণ্টা থেকে ৫ ঘণ্টা করার যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে নারী বাড়িতে সন্তানকে বেশি সময় দিতে পারবে। কিন্তু বাড়ির কাজ তো নারীর একার না। কর্মঘণ্টা কমানো বাড়ানোর বিষয়টা নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে জড়িত না। প্রশ্ন হলো, নারীর শ্রমের মূল্যায়ন হবে কিনা, সমান মযার্দা, সমান সুযোগ পাচ্ছে কিনা। আমরা নারীকে অর্থনীতির মূলধারায় তার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কিনা, সেটা নিয়ে ভাবছি না, কর্মক্ষেত্রে নারীর অনিরাপদ পরিবেশ নিয়ে কথা বলছি না, নারী কর্মক্ষেত্রে গেলে বাড়ির কাজ শেয়ার করতে হবে, সেটাতে মনোযোগ দিচ্ছি না বলেই নারীরা এই ঘণ্টা কমানো নিয়ে খুশি হতে পারছে না।’’

এই সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হতে পারে প্রশ্নে করপোরেটে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা আছে, এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘আমরা এই সেক্টরগুলোতে নারীদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এমন একটা সময়ে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি হাস্যকর। তবে, এটা যদি আসলেই হয়, আমি মনে করি নারীরা নিজেরাই সেটা হতে দেবেন না। ৫ ঘণ্টা পর যদি নারী সহকর্মীকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে হয়, সেক্ষেত্রে দেখা যাবে কোম্পানিগুলো আর নারীকর্মী নিচ্ছেই না। এ ধরনের অলীক কথা বলে নারীদের ভোট পাবে ভাবলে ভুল করছে তারা।’’

কর্মঘণ্টা ৮ থেকে ৫ ঘণ্টায় নামানোর উদ্যাগকে স্বাগত জানিয়ে নারী বিষয়ক কমিশনের প্রধান শিরিন হক বলেন, ‘‘তবে সেই কর্মঘণ্টা কমাতে হবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, কেবল নারীদের জন্য নয়।’’ 

তিনি বলেন, ‘‘একটা জিনিস পরিষ্কার, যারা এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা কেউ নারীর কর্মঘণ্টা কমিয়ে তাকে স্বাধীন সময় দিতে চান, ব্যাপারটা কিন্তু সেজন্য চাচ্ছেন না। নারী এই বাড়তি সময়টা তার নিজের মতো কাটাবে, সেজন্যেও নয়। এটা তাকে গৃহবন্দি করার পাঁয়তারা থেকে বলা হচ্ছে।’’ 

ইউরোপের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘‘সেখানে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হচ্ছে। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা থেকে ৩৬ ঘণ্টায় নেমেছে। ওরা ধারাবাহিকভাবে কমানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটা সবার জন্যে।’’

কবি, প্রাবন্ধিক এবং মিডিয়া ও জেন্ডার গবেষক আফরোজা সোমা বলেন, ‘‘কর্মক্ষত্রে নারী-পুরুষ এবং ট্রান্স (রূপান্তরিত নারী-পুরুষ) সব লিঙ্গের কর্মীর জন্য সমমর্যাদা নিশ্চিত করার জরুরত রয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি-৫ এর লক্ষ্যও হলো, নারীর বিকাশের পথে রাষ্ট্রীয়, আইনি ও সামাজিক যত প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলোকে দূর করা। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সেই লক্ষ্যে বহুদূর এগিয়েছে। সেখানে হঠাৎ করেই ‘কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার’ ভাবনাটাই অপ্রাসঙ্গিক,  বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। এই চিন্তা স্বয়ং বৈষম্য সৃষ্টিকারী। তাই এই খবরে খুশি হওয়ার কিছু নেই।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘‘সাধারণভাবে নারীদের কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি নারীদের জন্য সম্মানজনক ধারণা না। এখানে মূলত নারীদের অন্য সব নাগরিকের মতো সমান বলে বিবেচনা করা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, যখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি নারী, সেখানে তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ তাদের উৎপাদনশীলতার সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে। এ ধরনের উদ্যোগ আদতে চাপিয়ে দেওয়া। কারণ, কোনও নারী সংগঠন বা কোনও গবেষণা, কেউ এ ধরনের দাবি করেননি। বস্তুত এ ধরনের উদ্যোগ পুরুষতান্ত্রিক অভিভাবকত্বের ‘শৌর্য’ প্রকাশের একটা ধরন মাত্র।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published.