জার্মান রাষ্ট্রদূতের চোখে বাংলাদেশ দেশটা কি স্বৈরতান্ত্রিক

প্রশান্তি ডেক্স॥ ঢাকার সাপ্তাহিক প্রশান্তি একটি সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার ফারেনহোল্টজের (২১ নভেম্বর)। সাক্ষাৎকারটি পাঠ করে বুঝলাম, ‘সত্যের ঘন্টা আপনি বাজে।’ জার্মান রাষ্ট্রদূত হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রশংসা করেছেন এবং সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এই সরকার স্বৈরতন্ত্রী সরকার নয়।’ সাপ্তাহিক প্রশান্তি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যা প্রচার করতে চায়, তাকে এক কথায় নাকচ করে দিয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূত যা বলেছেন, তা পত্রিকাটিকে গিলতে হয়েছে। এ সম্পর্কে পরে আলোচনায় আসছি। আমাকে বিস্মিত করেছে ঢাকার একটি অনলাইনে ইউনূস সংক্রান্ত একটি খবর। খবরটি পাঠ করে নিজের সন্দেহভঞ্জনের জন্য ঢাকায় ইউনূস শিবিরের বন্ধুসহ কয়েকজন নিভরযোগ্য বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছি। তারা বলেছেন, খবরটি সঠিক; তাদের কথা শুনে মধুসূদনের কবিতার সেই অমর লাইন মনে পড়েছে- ‘একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে।’ প্রকাশিত খবরেই বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্যের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ড. ইউনূসই। তিনিই ড. কামালকে এই ঐক্যের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন; বিএনপিকেও ত্যাগ স্বীকারের উপদেশ তারই।’ এখন তার এই কি ইউটার্ন?Jerman Rasto dothe
অনলাইনের খবরে আরও মন্তব্য করা হয়েছে- ‘বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ও আক্রোশ নতুন কিছু নয়। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন সরকারের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন ড. ইউনূস। হাসিনা সরকারকে জব্দ করার জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের জন্য চেষ্টা করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এবারও কথা ছিল বিদেশে তার একমাসের অধিকাংশ কর্মসূচি শেষ করার পর এবং বাংলাদেশে ঐক্য প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার এক পর্যায়ে তিনি দেশে ফিরে তাতে যোগ দেবেন এবং নেতৃত্বও দেবেন।’
কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত দেশে না ফিরে বিদেশেই অবস্থান করা এবং তার সামাজিক ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনলাইনে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি ইতালিতে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রধানের সঙ্গে তার এক বৈঠক হয়। এই বৈঠকে খাদ্য সংস্থার প্রধান হাসিনা সরকারের খাদ্যশস্য উৎপাদনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ সময় ড. ইউনূসকে নীরব থাকতে হয়।’ অন্য একটি ইউরোপীয় সূত্র বলেছে, সামাজিক ব্যবসা নিয়ে ইউরোপ পরিভ্রমণকালে অধিকাংশ দেশের সরকারের মধ্যেই তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং তার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের প্রশংসা শুনতে পান। ফলে তিনি কিছুটা নিরন্ডৎসাহিত হয়ে আপাতত রাজনৈতিক কর্মকান্ত থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রকাশিত আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, দেশ থেকে বিদেশে আসার সময়ে তিনি সহকর্মী ও একান্তজনকে বলে এসেছেন, ‘এই মুহূর্তে আন্দোলন, নির্বাচন বা অন্য কোনো উপায়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানো সম্ভব নয়। কেননা হাসিনা খুবই বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। এ জন্য সরকারের সঙ্গে নতুন কোনো বিরোধে জড়িয়ে না পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বিদেশমুখী হয়েছেন। তিনি তার এই সিদ্ধান্ত ড. কামাল হোসেনকেও জানিয়েছিলেন।
আগেই বলেছি, একটি অনলাইন কাগজ এবং আরও দু’একটি সূত্র থেকে পাওয়া এই খবর কতটা সঠিক, আমি জানি না। তবে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ মহলের কয়েকজনের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, এটা একেবারে বানানো খবর নয়। তিনি প্রকাশ্যে মুখ ফুটে কিছু না বললেও তার কাছের লোক ও আপনজনের কাছে আপাতত ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতি ও বর্তমান সরকারের বিরোধিতা থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।
আমার ধারণা, তিনি শুধু ইউরোপ, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য সংস্থাকে নয়, ভারত এবং আমেরিকাকেও বাজিয়ে দেখেছেন, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কতটা নেওয়া যায়। সম্ভবত এ ব্যাপারে খুব উৎসাহী হওয়ার সংকেত তিনি পাননি। হয়তো ক্লিনটন ফ্যামিলি থেকেও তিনি উৎসাহিত হননি। ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য থেকেও বুঝে ফেলেন, হাসিনা সরকার সম্পর্কে জার্মান রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের মধ্যেই অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশের মনোভাবের আভাস রয়েছে। এ জন্য তিনি ড. কামালদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে নিজে সরে পড়তে চাইছেন। এটা সব বুদ্ধিমানই করে থাকেন। ড. কামালও ব্যক্তিগতভাবে বুদ্ধিমান লোক। ড. ইউনূস সংক্রান্ত খবরটি যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এখন ড. কামালের পক্ষে কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাকে টগর বোষ্টমীর মতো বলতে হবে, ‘বিএনপির সঙ্গে ঘর বেঁধেছি বটে; কিন্তু জামায়াতিদের হেঁসেলে ঢুকতে দেইনি।’ তিনি জানেন, জামায়াতিরা শুরু থেকেই ঐক্যফ্রন্টের হেঁশেলে ঢুকে বসে আছে।
ড. কামাল হোসেনের অবস্থা এখন না ঘরকা না ঘাটকা। তিনি বড় আইনজ্ঞ হতে পারেন; কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবেই মনে করেছিলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘোড়া বদল চায়; সুতরাং তার সময় এসেছে। তিনি এখন আন্তর্জাতিক প্রভুদের সাহায্যেই ফসিল থেকে আবার ফসল হয়ে উঠবেন। কিন্তু তার চিন্তার গোড়াতেই যে গলদ, তা এখন ক্রমশ ধরা পড়ছে। তিনি হাসিনা-বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে ‘গৃহত্যাগ’ করলেন বটে; তাতে শুধু ইজ্জতই খোয়ালেন। কোনো লাভ হলো না। শোনা যাচ্ছে, তাকে দিয়ে কাজ গুছিয়ে নিয়ে বিএনপি এখন বহু কাজে তাকে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। অন্যদিকে, পশ্চিমা জগতে হাসিনা সরকার আস্থা ও সমর্থন হারিয়েছে বলে তাকে যা বোঝানো হচ্ছিল, তা যে সর্বাংশে সঠিক নয়, ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূতের খোলামেলা বক্তব্যে তিনি হয়তো তাও বুঝতে পারছেন। আর ঠিক এই সময়ে তার খুঁটির জোর ড. ইউনূসও তার পেছন থেকে সরে যাচ্ছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। সাপ্তাহিক প্রশান্তি পত্রিকাকে আমি একটা ধন্যবাদ দিই। তারা জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকারটি টুইস্ট করেনি। তবে রাষ্ট্রদূতকে করা প্রশ্নগুলো দেখে মনে হয়, তারা প্রশ্নগুলো এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে রাষ্ট্রদূতের জবাবকে ব্যবহার করে হাসিনা সরকারকে বির্বত করতে পারে এবং হাসিনা সরকার সম্পর্কে তারা যা বলে, তা সত্য বলে দাবি করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রদূত পিটার তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও সততার সাহায্যে এমনভাবে প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন যে, যাতে শেখ হাসিনার সাফল্যের প্রশংসা করা হয়েছে এবং তার ভালোমন্দ কাজের মূল্যায়ন করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ভারতে দুই বছর (২০০৪-০৬) কাজ করেছি। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া সফর করেছি। বাংলাদেশে আসার আগে যা শুনেছিলাম, তা আসার পরে বদলে গেছে। বাংলাদেশের বিরাট অগ্রগতি ও উন্নয়ন দেখে আমি বরং অভিভূত হয়েছি।’ এরপর প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকের আর কোনো কথা থাকে না। তিনি রাষ্ট্রদূতকে অন্যান্য কথার পর টেনে নিয়ে গেলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে। তাকে জানালেন, এই আইন সংশোধনে রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিল সরকারের সঙ্গে আলোচনায়। তারপরও কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সরকার সেটি পাস করল। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সরকার আমাকে আশ্বস্ত করেছে যে, এই আইনের কোনো অপব্যবহার ঘটবে না। আমরা এ কথায় আস্থা রাখতে পারি।’ রাষ্ট্রদূতের মুখ থেকে এ ব্যাপারেও কোনো সরকারবিরোধী কথা বের করা যায়নি।
এরপর এলো জাতীয় সংলাপের কথা। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘গণতন্ত্র এমন বিষয় নয় যে, যা কেবল সরকারই ম্যানেজ করতে পারে। এটা একটি প্রক্রিয়া, যাতে সব পক্ষ অংশ নেবে। প্রত্যেক রাজনীতিকের ভূমিকা থাকবে। তাহলেই গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে।’ এই প্রসঙ্গে জার্মান রাষ্ট্রদূত বিএনপির অর্থাৎ বাংলাদেশে যারা কথায় কথায় সংলাপ বর্জন, নির্বাচন বর্জনের হুমকি দেয়, তাদের নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র মানে সর্বদাই সমঝোতা। কোনো এক পক্ষ দাবি করতে পারে না যে, তার পথই শতকরা সঠিক। যদি কেউ দাবি করে থাকে যে, আমি এই প্রক্রিয়ার অংশ নই, আমি এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেব না, তাহলে সে নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করতে পারে না।’ এই উক্তিটি কাদের লক্ষ্য করে রাষ্ট্রদূত করেছেন, তা সহজেই প্রণিধানযোগ্য। এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক প্রশান্তি সম্পাদকের বা তাদের সুশীল সমাজের মন্তব্য জানা গেলে ভালো হতো।
এই সাক্ষাৎকারে জার্মান রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে তাদের আলোচনা সম্পর্কে। রাষ্ট্রদূত প্রশ্নকর্তাকে বলে দিয়েছেন, ড. কামাল হোসেন তাদের আশ্বন্ত করেছেন, সরকারের সঙ্গে তাদের যে আলোচনা, তা ধারাবাহিক ও চলমান থাকবে (অর্থাৎ তারা ভাংচুরের কোনো পন্থা গ্রহণ করবে না)। রাষ্ট্রদূত ড. কামাল হোসেনকে বলে দিয়েছেন, বিরোধী দলের কাছে ইউরোপীয় দেশগুলো কী প্রত্যাশা করে।
এই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল, যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই বলে অহরহ চিৎকার (সম্ভবত সুশীল সমাজ) করে, তাদের উদ্দেশেই সম্ভবত তিনি বলেছেন, ‘আপনি যদি জার্মানির ইতিহাসের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন, পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে পৌঁছতে জার্মানদের বহু বছর লেগেছে। আমরা রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে পরিপকস্ফতা অর্জনের আগ পর্যন্ত টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মুখ দেখিনি। যদি আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় সব রাজনৈতিক দল ও মতের সমাবেশ ঘটে, তাহলে সেটা হবে এক বিরাট অগ্রগতি। তাকে সফল করতে হলে সবাইকে এই প্রক্রিয়ার অংশে পরিণত হতে হবে।’
বাংলাদেশে ধরপাকড়, মানবাধিকার হরণের অভিযোগ সম্পর্কে জার্মান রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। তিনি তাকে গুরুত্ব দেননি। বলেছেন, ‘বিশ্বের কোথাও যখন কোনো ধরনের মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটে, এখন সিভিল সোসাইটি, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং দূতাবাস গুলোর উচিত সরকারের সঙ্গে বসা, আমরা কীভাবে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারি এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘন এড়ানো যায়। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।’ রাষ্ট্রদূত এখানেও প্রশ্নকারীকে কূট নৈতিক ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, কোনো দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাও একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। চাইলেই তালগাছের মতো মাটিতে বসিয়ে দেওয়া যায় না।
এই সাক্ষাৎকারে যে প্রশ্নটিকে বড় করে তুলে ধরা হয়েছিল তা হলো, বর্তমান বাংলাদেশ একটি স্বৈরতান্ত্রিক দেশ কিনা? প্রশ্নকর্তা হয়তো আশা করেছিলেন, যেহেতু জার্মানির একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক বার্টলস বাংলাদেশকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় রেখেছে এবং বলেছে, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক শর্ত এখানে অনুপস্থিত। সুতরাং জার্মান রাষ্ট্রদূতও সে কথার পুনরাবৃত্তি করে সাক্ষাৎ গ্রহণকারীদের আশা পূর্ণ করবেন। তিনি তাদের আশা পূর্ণ করেননি। জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্কটি একটি বড় থিঙ্কট্যাঙ্ক স্বীকার করে নিয়ে তিনি তার বিপরীতে মতপ্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘আমি আসলে বাংলাদেশে পা রেখে ইতিবাচক ভাবে বিস্মিত হয়েছি।’
পিটার ফারেনহোল্টজ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যা চলছে তা স্বৈরতন্ত্র নয়।’ যে জার্মানি দু’দিন আগেও ছিল হিটলারের অধীনে একটি ভয়াবহ স্বৈরতান্ত্রিক দেশ, সে দেশের এক বিশিষ্ট নাগরিককে বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র চলছে কিনা জিজ্ঞেস করা হাস্যকর। তিনি তাই খোলাখুলি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক নয়। স্বৈরতান্ত্রিক দেশে কাজ করা, আমার দেশের অভিজ্ঞতাও আমার আছে।’ অর্থাৎ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জানেন, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র চলছে না। তার মতে, তিনি ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভ হতে দেখেছেন এবং সংবাদ মাধ্যমে সরকারের প্রচুর সমালোচনা হতে দেখেছেন। তারপরও তিনি কী করে বলবেন, এটা স্বৈরতন্ত্রী দেশ? জার্মান রাষ্ট্রদূতের এই সরাসরি কথাও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে দমাতে পারেনি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি অনেক নেতিবাচক কথা শোনেন। যেমন- দেশটিতে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে।
রাষ্ট্রদূত সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, এটা ডিকটেটরশিপ নয়।,.. আমি মনে করি, ‘বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কান্ট্রি ইন ট্রানজিশন। সম্পূর্ণভাবে কার্যকর থাকা অর্থনীতি দেশটিতে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলমান। গণতন্ত্র রাতারাতি আসে না। এ জন্য সময় দরকার। সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভেঙে এগোতে হয়। সে জন্যই আসন্ন নির্বাচন এতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনে সত্যিকারের বিরোধী দল সংসদে বসলে সেটা হবে এক ধাপ অগ্রগতি।’ সবশেষে জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের সামনে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষমাণ। এই বিবেচনায় আমি আশাবাদী।’
এই সাক্ষাৎকারটি দেওয়ার জন্য জার্মান রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সাপ্তাহিক প্রশান্তি পত্রিকাকেও এ জন্য ধন্যবাদ জানাই যে, তারা যে মতলব নিয়েই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করে থাকুক না কেন, সাক্ষাৎকারটি তারা যথাযথ প্রকাশ করেছে। মনে হয়, দু’একটি দেশ ছাড়া ইউরোপের অধিকাংশ দেশই বাংলাদেশ ও হাসিনা সরকার সম্পর্কে প্রশংসার ও সমর্থনের মনোভাব পোষণ করে। জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকারে শুধু জার্মানি নয়, হাসিনা সরকার সম্পর্কে অধিকাংশ ইউরোপিয়ান দেশের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে মনে হয়। ড. কামাল হোসেন ও সুশীল সমাজের সুশীলরা অনবরত পশ্চিমা দেশগুলোকে বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, স্বৈরতন্ত্র চলছে। সাপ্তাহিক প্রশান্তি কেও এই প্রচারণায় শরিক। কিন্তু এই প্রচারণা যে কাজে দেয়নি, সাপ্তাহিক প্রশান্তিতে প্রকাশিত জার্মান রাষ্ট্রদূতের এই সাক্ষাৎকারটিই তার প্রমাণ। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে পাশ্চাত্যে খারাপ ধারণা থাকতে পারে। কিন্তু তিনিও যে ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, বাস্তবে তার বিপরীত অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে পরিপূর্ণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত- এ কথা কেউ বলবে না। রাতারাতি তা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এটুকু বলা চলে, হাসিনা সরকার অত্যন্ত বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠার দিকে এগোচ্ছে। তাকে প্রচন্ড লড়াই করতে হচ্ছে সামরিক ও অসামরিক স্বৈরতন্ত্রের লেগাসি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। এই সরকারকে লড়াই করতে হচ্ছে মধ্য যুগীয় ধর্মান্ধতা ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে। আর এসব অপশক্তির দ্বারা কবলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়। কামাল সাহেবরা যতই গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা বলুন, তারা অতীতমুখী বাতিল রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছেন আর ভবিষ্যৎ মুখী উজ্জ্বল রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছেন শেখ হাসিনা ও তার মহাজোট। তাই আসন্ন নির্বাচনেও এ সরকারের সাফল্য ও বিজয় কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.