শাহ আহমেদ॥ বাংলাদেশের সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। দেশ ও জাতির জন্য অতুলনীয় ছিল তার ত্যাগ, সংগ্রাম এবং অবদান। কিন্তু তা সত্ত্বেও বছরের অন্য সময়ে তো বটেই, এমনকি মৃত্যুবার্ষিকীতেও তাকে খুব একটা স্মরণ করা হয় না। স্মরণ না করার পেছনের কারণ সম্পর্কে বলতে গেলে কথার পিঠে কথা বাড়বে বলে বরং ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো দরকার। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ব পাস্তিানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে তার ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাকও তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের পর্যায়ক্রমিক যে আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রধান উদ্যোগী নেতা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচারের সূচনা হলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমাগত তীব্রতর করেছিলেন। মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসন চাইতেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ীÑ যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের মতো প্রতিটি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছিল।
স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হিসেবে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সংগঠিত করা ছিল মওলানা ভাসানীর পরিচালিত আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশের বিভিন্ন দাবি সংবলিত ২১ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলার দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ‘শেরেবাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী একজন প্রধান নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও মূলত নেতৃত্বের কোন্দলে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। সে সময় থেকেই মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার কথা বলে এসেছেন। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন এবং ১৯৫৬ সালের ৭ ও ১৫ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, স্বায়ত্তশাসন না দেয়া হলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার কথা চিন্তা করবে। ১৯৫৬ সালের প্রথম সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন না দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হিসেবে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলনে’ মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ তথা বিদায় জানানোর এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টি সাধারণ ছিল না। কারণ, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তখন কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল। মন্ত্রীসহ দলের বেশির ভাগ নেতাই সে সময় মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তার নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির পদ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি দল গঠন করেছিলেন (জুলাই, ১৯৫৭)। এর পর মওলানা ভাসানী ন্যাপের মাধ্যমে তার স্বাধীনতামুখী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন।
১৯৬৯-এর যে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রচন্ড চাপে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল, তার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেটা এমন এক সময়, যখন ১৯৬৬ সাল থেকে কারাগারে থাকায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতার পক্ষে কোনো ভূমিকা পালন করাই সম্ভব ছিল না। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা গভর্নর হাউজ ঘেরাও করে এবং পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত হন। প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী হরতালের ডাক দেন। আন্দোলন সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মওলানা ভাসানীর এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা আর ১১ দফাভিত্তিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীরা। বাতিল হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এ দেশেরই কোনো কোনো নেতার প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সাময়িককালের জন্য বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হয়ে পড়লেও মওলানা ভাসানী পরিস্থিতিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যখন স্বাধীনতার দাবি মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শুরু করেছিল। স্বাধীনতামুখী এই অবস্থান থেকে জনগণকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বস্তুত ‘৬৯-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ছিল সরাসরি পাকিস্তানবিরোধী সফল অভ্যুত্থান এবং তার প্রধান নির্মাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যথারীতি চরম উপেক্ষা দেখিয়েছে। এ দেশের নেতারাও তখন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। অন্য দিকে, মওলানা ভাসানী নিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেতার অবস্থান। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিছানা থেকে ছুটে গেছেন উপদ্রুত অঞ্চলে। ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ভাসানী এরপরই সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে আহ্বান জানানোর পরপর ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে পবিত্র কুরআনের সূরা ‘কাফিরুন’ থেকে আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘লাকুম দীনুকুম ওয়া লিয়া দীন’ (তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম)। অর্থাৎ তোমার রাস্তায় তুমি যাও, আমাকে আমার রাস্তায় চলতে দাও। এটা ছিল সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। এর ভিত্তিতেই মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন বর্জন করেছিল। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, মওলানা ভাসানী নির্বাচনে অংশ নেননি বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা এবং শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান নেতার অবস্থান অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।
নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আরো একবার স্বাধীনতার আহ্বানমুখে সোচ্চার হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। ৪ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ মুজিবের উদ্দেশে বলেছিলেন, ইয়াহিয়ার সাথে সমঝোতা বৈঠক করার পরিবর্তে তার উচিত বাংলার সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করা। সর্বশেষ এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী ২৩ মার্চকে ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেনÑ যার অর্থ, ওই দিন থেকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার অভিযান শুরু হয়েছিল, ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সস্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি আসামের ফুলবাড়ি হয়ে ১৫ এপ্রিল ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিতি থাকায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার তাকে অঘোষিতভাবে নজরবন্দী অবস্থায় রেখেছিল। কিন্তু নিজের স্বাধীনতা হারিয়েও মওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে একজন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধকে সফলভাবে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানদের কাছে বংলাদেশকে সমর্থন করার ও স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তৎকালীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানী অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন। স্বাধীনতার পরও তার সে দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের শোষণ, লুণ্ঠন এবং ভারতমুখী নীতি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনিই সবার আগে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ভারতের সম্প্রসারণবাদী হস্তক্ষেপ ও পানি আগ্রাসনসহ বাংলাদেশবিরোধী সব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার থেকেছেন এবং মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে, প্রায় ৯৬ বছর বয়সেও ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন (১৬ মে, ১৯৭৬)। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, অমন একজন সংগ্রামী জাতীয় নেতার নামও আজকাল যথাযথ সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয় না। বলা দরকার, মওলানা ভাসানীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলই সুবিচার করেনি। মূলত সে কারণেই কোনো কোনো দলকে ১৯৭৫-পূর্ব ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়, প্রতিপক্ষের সামনে মাথা নত করতে হয়। কারণ, স্বাধীনতামুখী দীর্ঘ সংগ্রামে দলগতভাবে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। কোনো কোনো দলের তো এমনকি অস্তিত্বও ছিল না। সে ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর কিন্তু বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামী ভূমিকা রয়েছে। আসলেও একজন প্রধান জাতীয় নেতার ভূমিকাই পালন করে গেছেন তিনি। লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষকshahahmadreza@yahoo.com