পিলখানায় নারকীয় হত্যাকান্ড এবং অপশক্তির ষড়যন্ত্র…মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

বা আ॥ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ইতিহাসে সোনালি দিনের আলোকবর্তিকা যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু বেদনাবিদুর কলঙ্কিত দিন। সে রকমই একটি বিষাদময় দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি। ২০০৯ সালের এই দিনে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত ট্র্যাজেডির করুণ আর্তির তাড়না আমাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করবে আরো অনেক দিন। ঘটনার ১০ বছরের মাথায় এসে পেছনে ফিরে তাকালে সে প্রশ্নগুলো এখনো আমাদের তাড়া করে, সেটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কলঙ্ককে পেছনে ফেলে আমরা কত দূর সামনে এগোতে পেরেছি তার মূল্যায়নও জরুরি। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বুধবার। এক দিন আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় যথারীতি পিলখানার দরবার হলে বসে বার্ষিক দরবার। সারা দেশ থেকে আসা বিডিআরের কর্মকর্তা, জেসিও, এনসিও এবং বিপুলসংখ্যক জোয়ানে তখন পরিপূর্ণ গোটা দরবার হল। ঠিক ৯টায় দরবার হলে হাজির হন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। এক আনন্দঘন জাঁকজমকপূর্ণ মনোরম পরিবেশে তখনো কেউ ভাবতে পারেনি একটু পরে এখানে কী ঘটতে যাচ্ছে।pelkhana nerkeya
আগে থেকেই প্রস্তুত ষড়যন্ত্রে জড়িত বিডিআর সদস্যরা মহাপরিচালকের সামনে তাদের কিছু দাবি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে শত শত বিডিআর সদস্য ব্যারাক থেকে বেরিয়ে দরবার হল ঘিরে ফেলে। শুরু করে বৃষ্টির মতো গুলি। বেঁচে ফিরে আসা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রথম ধাক্কায় অর্থাৎ মোটামুটি সাড়ে ৯টার মধ্যে মহাপরিচালক জেনারেল শাকিলসহ বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে তারা হত্যা করে। সব মিলিয়ে সেনা কর্মকর্তা নিহত হন ৫৭ জন। ৪০ জন কর্মকর্তা আক্রমণের ভেতরে পড়েও প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। সেদিন যা ঘটেছে সে নির্মমতার ক্ষতচিহ্নকে কোনো প্রকার প্রলেপ দিয়ে ডেকে দেওয়া যাবে না। কিন্তু সাস্ত¡নার জায়গা হলো, বিচারব্যবস্থার যেকোনো মানদন্ডে, খুবই স্বল্প সময়ে, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এরই মধ্যে হাইকোর্ট পর্যন্ত এই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রত্যক্ষ খুনিরা যথোপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। বিচারিক আদালত রায় দেন ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। আর হাইকোর্টের রায় আসে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর। মামলার আয়তন অর্থাৎ একটি মামলায় এতসংখ্যক আসামি ও সাক্ষী নজিরবিহীন ঘটনা। হাইকোর্টের রায় অনুসারে ১৩৯ জন মৃত্যুদন্ড, ১৮৫ জন যাবজ্জীবন এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড পেয়েছে ২০০ জন। যথোপযুক্ত বিচার তো হয়েছেই, তার সঙ্গে নিহতদের স্বজনরা রাষ্ট্রসহ সর্বশ্রেণির মানুষের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিশাল হৃদয় ও উদার মন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলে থাকেন, স্বজন হারানোর বেদনা তিনি বোঝেন। এটি শুধু মুখের কথা নয়, কার্যত তিনি সেটি দেখিয়েছেন। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়। আকস্মিক নৃশংসতার শিকার হয়ে স্বজন হারানোর বেদনা কোনো দিন ঘুচবে না, ঘুচবার নয়। কথায় আছেযার যায় সে-ই বোঝে কী সে হারাল। ঘটনা ঘটেছে ১০ বছর হয়ে গেল। কিন্তু বছর ঘুরে ২৫ ফেব্রুয়ারি এলেই যখন পেছনে ফিরে তাকাই, কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারি না। কেন, কী জন্য এবং কারা এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের নেপথ্যের খলনায়ক। শুধু কিছু দাবিদাওয়া, অভিযোগ ও অসন্তুষ্টির জন্য একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাহিনীর সাধারণ সৈনিকরা তাদের বাহিনীপ্রধানসহ ৫৭ জন কর্মকর্তাকে তাত্ক্ষণিকভাবে হত্যা করতে পাওে এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
তাহলে কারা এর পেছনে। যখন কেউ অথবা কোনো গোষ্ঠী বুঝতে পারে নিজেদের রচিত পাপের চরম কঠিন প্রায়শ্চিত্ত করার সময় আসন্ন তখন অস্তিত্ব রক্ষার অস্থিরতায় উত্তেজিত পশুচিত্তের তাড়নায় সুযোগ পেলে তারা যা কিছু করতে পারে। পরিণতির যৌক্তিকতা তখন তাদের মাথায় থাকে না। এ রকম কোনো গোষ্ঠীই তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের জায়গাটিকে কাজে লাগানোর ষড়যন্ত্র করতে পারে, সেটিই বিশ্লেষণ ও যুক্তির কথা। এই ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে নৃশংস হত্যায় অংশগ্রহণকারী সৈনিকরা। এ বিষয়ে হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ চিন্তার খোরাক জোগায়। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, এরই মধ্যে বৃহত্তম ষড়যন্ত্র ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সদ্য ক্ষমতায় আসা সরকারকে বিপদে ফেলা ও রাজনৈতিক সংকট তৈরির চেষ্টা ছিল। যেখানে এসে ঠেকেছে তা হলো, আদালত ও তদন্তকারী সংস্থা কেউ-ই ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারেনি। তবে সর্বাগ্রে যে কথাটি সামনে আসে তা হলো, তখনকার মাত্র ৫০ দিনের বয়সী সদ্য ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার বিপদে পড়লে কারা লাভবান হতো। এটি তো স্পষ্ট যে ২০০৯ সালের পিলখানার ঘটনার পরিণতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা, যুদ্ধাপরাধীরা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা লাভবান হতো। আর এটি সবাই জানে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিল ক্ষমতায় গেলে তারা উপরোক্ত অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করবে এবং বিদেশি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জায়গা বাংলাদেশের মাটিতে হবে না।
পিলখানা হত্যাকান্ডের ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়ায় যেহেতু কোনো ষড়যন্ত্রকারী চিহ্নিত হয়নি, তাই আমরাও কারো দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে পারছি না। তবে আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের কোনো সন্তান, তা হতে পারে পিলখানায় শহীদ হওয়া কোনো কর্মকর্তার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ মনের তাগিদে সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচন করে ছাড়বে। তখন জানা যাবে পিলখানার নৃশংস হত্যাকান্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেখা যাবে একাত্তরে যারা আমাদের দেশের ভেতর থেকে শত্রুপক্ষ ছিল তারা এবং ১৯৭৫ সালের পরে যারা এই পরাজিত শত্রুদের পুনর্জীবন দিয়েছে, এসব পক্ষ মিলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় তার সব কিছু বিনাশ করার ধারাবাহিক অপতৎপরতার পথে এবং নিজেদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ঠেকাতে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় নেপথ্যের অশুভ শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। পিলখানার নারকীয় ঘটনার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দক্ষতা, রাজনৈতিক পরিপক্বতা, ধৈর্য, সাহস, বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাইকোর্ট রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘এ ঘটনা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থন্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। কিন্তু সে চক্রান্ত রুখে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। সদ্য নির্বাচিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’ কিন্তু সেই অশুভ শক্তি, যারা এই চক্রান্তের প্রধান হোতা এবং এই হোতাদের সমর্থক এক শ্রেণির বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী প্রপাগান্ডা চালান এই বলে যে ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সরাসরি সেনা অভিযানের হুকুম না দেওয়ায় হত্যাকান্ডের পরিধি নাকি বেড়ে গেছে। অথচ তখনকার প্রেক্ষাপট পরিস্থিতির বিবেচনায় এসব কথা মোটেই ধোপে টেকে না।
একটু বিশ্লেষণের দিকে নজর দিলেই এটি বোঝা যায়, যেকোনো অপারেশনের হুকুম দেওয়ার আগে হুকুমদাতাকে অবশ্যই শত্রুর চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনতে হয়। সেনা অভিযান শুরু হলে ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যাযজ্ঞের পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির জন্য পিলখানার ভেতরে জীবিত বাকি কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দ্রুত হত্যা করার সমূহ আশঙ্কা ছিল। তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা ও সেনা অভিযানকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য সংগত কারণেই তাদের কাছে রক্ষিত হেভি মর্টার ও মেশিনগানের মাধ্যমে পিলখানার চারদিকে এলোপাতাড়ি ফায়ারিং চালাত এবং তাতে আশপাশের ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত। ঢাকার বাইরে তখনকার ৪৬টি বিডিআর ব্যাটালিয়ন এবং ১২টি সেক্টরে অবশ্যই ষড়যন্ত্রকারীদের নির্দিষ্ট লোক ছিল, যাদের দ্বারা বিভিন্ন সেক্টর সদর দপ্তর এবং ব্যাটালিয়নে ২৫ ফেব্রুয়ারিতেই কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই পিলখানায় সেনা অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে একই সময়ে দেশের অন্যান্য জায়গায় অবস্থিত বিডিআর ব্যাটালিয়ন ও সেক্টরের ভেতর থেকে বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করে অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালালে দেশব্যাপী একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। অনেক কিছুই তখন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। তা ছাড়া স্থানীয় ব্যাটালিয়ন ও সেক্টরে অবস্থিত সেনা কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়ত। কাউকেই বাঁচানো যেত না। সুতরাং ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সরাসরি সেনা অভিযান চালালে ক্ষয়ক্ষতি কম হতো বা আরো সেনা কর্মকর্তাকে বাঁচানো যেত এমন কথার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না; বরং সব দিক থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হতো। মহাপরিচালকসহ বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে তো বিদ্রোহের প্রথম ধাপেই মেরে ফেলেছে। তাহলে সেনা অভিযান চালিয়ে লাভটা হতো কী? উপরন্তু সারা দেশে বিডিআর ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অনিয়ন্ত্রিত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। বিপন্ন হতো গণতন্ত্র। সংগত কারণেই বোঝা যায়, ষড়যন্ত্র কারীদের উদ্দেশ্য ছিল বড় ধরনের একটি গণহত্যা সংঘটিত হোক এবং তার সব দায়দায়িত্ব গিয়ে পড়ুক সরকারের ওপর। তাহলে ষড়যন্ত্র কারীদের লক্ষ্য অর্জিত হতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধৈর্য ও কৌশলের কাছে তারা পরাজিত হয়েছে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published.