বা আ॥ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আজ বিশ্ব স্বীকৃত। তাঁরই নেতৃত্বে বাঙালী জাতি অর্জন করেছিল বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। এ মহান নেতার চিন্তা-চেতনায় সবসময় কাজ করত বাঙালীর মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
তিনি ছিলেন বাঙালী জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা এবং বাঙালী জাতীয়তা বাদের প্রবক্তা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনসহ বাঙালীর মুক্তি ও অধিকার আদায়ে পরিচালিত সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনিই নেতৃত্ব দেন। এজন্য তাকে জীবনে অনেকবার কারাজীবন বরণ করতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। বাঙালীর অধিকারের প্রশ্নে তিনি কখনও আপোস করেননি। তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য আজ এ দেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে।
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার গত ২২ ডিসেম্বর তারিখে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ নামক কবিতায় তাঁর সেই অবদানের প্রতিধ্বনি খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ-ই বাঙালীর পরিচয়ের উন্মেষ ঘটায়। ৭ মার্চের সে ঐতিহাসিক ভাষণ-ই বাঙালীর মুক্তির সনদ, বাঙালীর স্বাধীনতার ম্যাগনাকার্টা। ঐতিহাসিক এই কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে বাঙালী তার ভাষার অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার সর্বোপরি পাকিস্তানীদের নির্মম অত্যাচার, লুণ্ঠন, নিপীড়নের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাঙালী হিসেবে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাতন্ত্র্য লাল সবুজ পতাকার অধিকারী হয়।
বাঙালীর স্বাধীনতার মূল শক্তি, মূল নিয়ামক বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রদত্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের এ তেজস্বী ভাষণগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ। বাঙালী জাতিকে পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে বাঙালীর মুক্ত আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিজের স্বপ্ন, নিজের চিন্তা-চেতনাকে নিজের করার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি ভাষণ সমগ্র বাঙালী জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিয়েছে তা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল।
বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত এ ভাষণ ছিল সাবলীল, সহজে বোধগম্য, ছেদহীন, নির্মেদ এবং অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। দশ লাখ বাঙালীর জনসমুদ্রে বক্তব্য উপস্থাপনের ঢং ছিল এতই সাবলীল যে বক্তব্যের প্রত্যেকটি শব্দ উপস্থিত লাখো জনতার বুকে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। শব্দের উঠানামার সঙ্গে উপস্থিত সকলের মন ও মানসের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণের বজ্রকণ্ঠ বিশাল জনসমুদ্রে কখনও উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করেছে, আবার কখনও বিশাল জনসমুদ্র অবিশ্বাস্যভাবে পিনপতন নীরবতায় পরিণত হয়েছে। সেই সিড়ি বেয়ে ২৬ মার্চ, ১০ এপ্রিল, ১৭ এপ্রিল সর্বোপরি ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস।
ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির কারণে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজ বাংলাদেশের গন্ডি- পেরিয়ে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সারা বিশ্বের নির্যাতিত বিশ্ব নাগরিকের অধিকার আদায়ের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের যে সকল নির্যাতিত সম্প্রদায় আজও তাদের স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ উদ্দীপনা জোগায়। তাঁর সে বজ্রকণ্ঠ আজ বিশ্ব গবেষণার আকর ও বিশ্ব সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে। ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি দেরিতে হলেও বঙ্গবন্ধুর তেজস্বী এ ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য।
পরাধীন বাংলার আকাশে-বাতাসে রেসকোসের পড়ন্ত বিকেলে যে বজ্রকণ্ঠ হতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উদগীরণ হয়েছিল, মানবতা, মানবাধিকার, বাঙালীর মুক্তির ব্যঞ্জনা দশ লাখ বাঙালীর প্রাণের ভেতরে যেভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল, ঠিক স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আজও সে ভাষণ অনুরূপ প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে। আজও বাঙালীর পাথেয় বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ। ঐতিহাসিক সে ভাষণের অমিয় ধারায় বাঙালীর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব মিডিয়াও সেদিন গর্জে উঠে ছিল। তার জ্বলন্ত সাক্ষী আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজ উইক তাদের ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালের এক প্রচ্ছদ নিবন্ধে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। একটি ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মুখপাত্র সেদিন রেসকোর্সের অমর বক্তব্যকে বঙ্গবন্ধুর অমর কাব্য হিসেবেই উল্লেখ করে সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে ছিল। আন্তর্জাতিক সাময়িকীর সে মূল্যায়নকে অনেকে অতিরঞ্জিত ভেবেছিল কিন্তু আজ টঘঊঝঈঙ কর্তৃক প্রদত্ত স্বীকৃতির মাধ্যমে ‘গবসড়ৎু ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ জবমরংঃবৎ’ এ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অন্তর্ভুক্তি পুনরায় সে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইউনেস্কো এর ওহঃবৎহধঃরড়হষ অফারংড়ৎু ঈড়সসরঃঃব (ওঅঈ) এর সকল সদস্যদের মনে ৪৮ বছর পূর্বে প্রদত্ত বক্তব্য আজও ঠিক সেভাবেই দাগ কেটেছে। তাদের প্রাণের স্পন্দনে বঙ্গবন্ধু সে ভাষণ বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সুর তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায়, তাঁর নেতৃত্বেই ছিল নিপীড়িত মানুষের মুক্তি।
লেখক : গবেষক।