বা আ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিটি সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তেমনিভাবেই স্বাধীন বাংলা বেতারের একটি কেন্দ্র একটি সেক্টর হিসেবে কাজ করেছে। উদ্দীপনামূলক দেশাত্মবোধক গান, রম্য নাটক, বজ্রকণ্ঠ (বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের অংশ বিশেষ), কথিকা, চরমপত্র, পুঁথিপাঠসহ সব কিছুই তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তখন প্রতিটি বাঙালি সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাতের শেষ পর্যন্ত কান পেতে শুনত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দিতে সমবেত গান ও নাটক পরিচালিত হতো। যে ব্যক্তির নির্দেশ ও উৎসাহে সবাই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল, সেই মহান ব্যক্তি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনাগুলো তখন বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানে নিয়মিত শোনানো হতো, তাতে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবনী গান বলতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান। সেসব গান দিয়েই সংশ্লিষ্ট কণ্ঠশিল্পী সুরকার ও গীতিকাররা হয়ে আছেন অমর। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটি হচ্ছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও আনোয়ার পারভেজের সুরে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। এটি গেয়েছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটিও ছিল রক্ত গরম করা উন্মাদনার। শাহনাজ রহমতুল্লাহর আরেকটি গান ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা’র গীতিকার ও সুরকার ছিলেন আবদুল লতিফ।
এ ছাড়া এ তালিকায় রয়েছে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথা ও অংশুমান রায়ের সুরে ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে’, আপেল মাহমুদের গাওয়া ও সুরারোপিত গোবিন্দ হালদারের লেখা ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, আপেল মাহমুদের সুর ও সংগীতে সমবেত কণ্ঠে গাওয়া ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’, গোবিন্দ হালদারের লেখা ও সমর দাসের সুরে সমবেত কণ্ঠের গান ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল’, গোবিন্দ হালদারের কথা ও আপেল মাহমুদের সুরে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ফজল-এ-খোদার লেখা এবং মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুর-কণ্ঠে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, সিকান্দার আবু জাফরের লেখা ও শেখ লুৎফর রহমানের সুরে সমবেত কণ্ঠে ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, সলিল চৌধুরীর লেখা সমবেত সংগীত ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এ জনতা’, নঈম গহরের লেখা ও সমর দাসের সুরে সমবেত সংগীত ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, আলী মহসিন রাজার লেখা ও খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার সুরে রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া ‘ছোটদের বড়দের সকলের’ উল্লেখযোগ্য।
এসব গানের আবেদন এতই গভীর যে, সে সময়ে এসব গান বাঙালি হৃদয়ে যে উন্মাদনা তৈরি করেছিল, এখনো সে আবেগ আবেদন এতটুকুও কমেনি। যুগ যুগ ধরে এ গানগুলো বাঙালির হৃদয় আসীন হয়ে আছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বেশ কিছু স্লোগান ছিল বেশ জনপ্রিয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধা এক একটি গ্রেনেড। শুধু পার্থক্য এই গ্রেনেড একবার ছুড়ে দিলে নিঃশেষ হয়ে যায়, আর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের বারবার গ্রেনেড হয়ে ফিরে আসে’, ‘বাংলার প্রতিটি ঘর আজ রণাঙ্গনÑ প্রতিটি মানুষ সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার জ্বলন্ত ইতিহাস’, ‘প্রতিটি আক্রমণের হিংসাত্মক বদলা নিন, সংগ্রামকে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে দিন’, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্যসামগ্রী ব্যবহার বর্জন করুন, শত্রুর বিরুদ্ধে অবরোধ গড়ে তুলুন’, জল্লাদ বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করুন, নিকটবর্তী মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে খবর দিন’।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এমআর আখতার মুকুলের রম্যকথিকা ‘চরমপত্র’ এক ইতিহাসের নাম। এ ছাড়া কল্যাণ মিত্র রচিত রাজু আহমেদ ও নারায়ণ ঘোষের কণ্ঠে জীবন্তিকা ‘জল্লাদের দরবার’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অংশ বিশেষ নিয়ে নির্মিত অনুষ্ঠান ‘বজ্রকণ্ঠ’, আবু তোয়াব খানের রম্যকথিকা ‘পিন্ডির প্রলাপ’, মুস্তাফিজুর রহমানের কথিকা ‘কাঠগড়ার আসামি’ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।