সিলভিয়া পারভিন॥ কিছু মানুষের প্রতিবাদ আর গুটি কয়েক সমালোচনাযুক্ত ফেসবুক পোস্ট ছাড়া নাসিরনগরের মতো ঘটনা থেকে কি ফল পাওয়া গেল? শুধু কি নাসিরনগর? রামুর ঘটনা খুব বেশি দিনের না। এ ঘটনা গুলো কোনো উস্কানি নয়। এসব যে পূর্ব পরিকল্পিত সেটা বুঝতে কি খুব বেশি জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়?
সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক ভাবে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা। যেখানে একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করছে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ যখন একটি রুল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, ঠিক তখনই এমন ঘটনা ঘটছে। আমরা যারা নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক সুশীল সমাজের বিশেষ শ্রেণি ভাবি কিংবা ভাবতে পছন্দ করি আজকে তাদের ভূমিকা কি? এই কয়েকদিনে আমরা কত কথা বললাম, কত কিছু লিখলাম। কিন্তু একটি বারও কি অনুধাবন করলাম যে, এমন ঘটনা কেন বার বার ঘটছে? কি উদ্দেশ্যে ঘটানো হচ্ছে? কারাই বা এর পেছনে থেকে আগুনে বাতাস দিচ্ছে?
সুশীল সমাজ টকশোতে বসে প্রথম কথাতেই সরকারকে আঘাত করে বেশ মজা পান, কিন্তু কখনো কি অনুধাবন করতে পারেন যে, সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে সরকারের আসলে কি লাভ? বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার আগে থেকেই এদেশে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা চলে এসেছে। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে দুভাগ করা হয়েছে একটি মানচিত্র। বাস্তুহারা হয়েছে শত শত মানুষ। এ জন্যে দায়ী কারা? হিন্দু মুসলমান-হিন্দু মুসলমান করে আমরাই নিজেদের আলাদা করেছি। একজন রসরাজ বা একটা ফেসবুক পোস্ট এর জন্যে দায়ী নয়। দায়ী আমাদের এ সমাজ। দায়ী এ সমাজে মানুষের মুখোশে বসবাসরত হায়েনারা। রসরাজরা এর শিকার। একটি স্বাধীন দেশে তার নাগরিকরা স্বাধীনভাবে বসবাস করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে মানুষ যখন হিংস্র রূপে সমাজে আবির্ভূত হয় তখন সেটা যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রকে প্রতিহত করতে হয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, একটা বিশেষ সময়কে উপলক্ষ করে এই ধরনের ঘটনা ঘটে। যেমন দুর্গাপূজা। প্রতিবছর এ পূজার সময় প্রতিমা ভাঙচুর হতে দেখি। কিন্তু এবারই প্রথম দুর্গাপূজার সময় এমন ঘটনা ঘটেনি। কারণ, হায়েনার দল সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। তাই তারা বেছে নিলো কালী পূজার সময়টিকে। এ থেকেই ব্যাপারটি অনেকটা পরিষ্কার হয় যায় যে এটি কোন উস্কানি কিংবা হঠাৎ ফেসবুক থেকে ছড়িয়ে পরা কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। এটি সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিত একটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনেক কথাই বলছি। “আমি মালাউন” হ্যাশ ট্যাগ ব্যবহার করছি। কিন্তু আসলে কি আজ নতুন করে শুনছেন মালাউন কিংবা তার অর্থ? সত্য হচ্ছে- এই ভূখন্ডে হিন্দু সম্প্রদায়কে এই নামে ডাকা হয় অনেক বছর ধরে। কখনও কখনও বন্ধুবান্ধবদের আড্ডাতেও এই নামে ডাকা হয়। সেই সময় কিন্তু আমরা প্রতিবাদ করি না। “মালাউন” কে গালিতে পরিণত করার আগেও এই মাটিতে শিক্ষিত সুশীল সমাজ ছিল, পেশাজীবী কিংবা শিক্ষক ছিল, ছিল সরকার, ছিল রাষ্ট্র, কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। এই যে বাড়তে দেয়া শব্দটি- “মালাউন।” তা আমরাই আজ এই পর্যন্ত এনেছি। প্রতিবাদ এই দেশে অনেক কিছু নিয়েই হয়েছে। কিন্তু আজকে এই “মালাউন” নিয়ে যখন কথা উঠেছে তখন চারদিক থেকে উঠে আসছে “আমি মালাউন”! প্রশ্ন হচ্ছে কেন প্রতিবাদ আগে হয়নি?
বলবেন প্রতিবাদ করে লাভ কি? কিছুই হয় না! কার কাছে করব? ভুলে যাবেন না, প্রতিবাদ প্রতিরোধেই এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। যারা মালাউন বলে গালি দিচ্ছে তাদের প্রতিহত করুন সাথে সাথে। এটি হোক পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধুর আড্ডা কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গন। “ভয়ের কারণে মুখ খুলেন না হিন্দুরা” এই কথাটাও প্রতিষ্ঠিত হতে দিয়েন না। এই দেশের মাটিতে যেমন আমার জন্ম তেমনি আপনারও। “হিন্দু” মানুষ- একথাটি আপনারাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আরও দুটি শব্দ- সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু। এই শব্দ দুটির মানে কি? এ শব্দের মাধ্যমেও বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। গুরুরা বড় মনে করে শাসন করছে। লঘুরা নিজেদের ছোট মনে করে নিজেদের অনিরাপদ ভাবছে। আমি যে জায়গায় বসবাস করেছি তাও একটি হিন্দু প্রধান এলাকা। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি- হিন্দু বলে নিজেদের ভয় করবেন না। তাতে আপনাদের ক্ষতি, আমাদেরও ক্ষতি। কারণ, “স্বার্থ” কখনও হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান দেখে না। আর এটি তো রাজনৈতিক স্বার্থ। অশান্তি সৃষ্টি করে সেটার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা হাসিলের স্বার্থ।
একটি বিষয় আমাকে খুব ভাবায়। এদেশের মানুষ সব কত কমিটি করে নিজেদের আলাদা করেছে। একটি কমিটি আছে- “বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ”। এমন কেন হবে! আপনি আমি পাশাপাশি বাড়িতে থাকি। একই জায়গায় বাজার করি। সকালে ঘর থেকে বের হলেই একে অপরের মুখ দেখি। যেখানে আপনি আমাকে আলাদা করে ফেললেন শুধু ধর্মের কারণে? আজকে যদি পাশাপাশি থাকতে পারি, অধিকার আদায়ের জন্যে রক্ত দিতে পারি তাহলে এক সাথে এক কমিটিতে থাকতে পারবো না কেন? আমরা ঈদ একসাথে করি, পূজা এক সাথে করি, পাড়ার ছোট চায়ের দোকানে একই কাপে চা খাই। কোনটা হিন্দু কাপ আর কোনটা মুসলমান কাপ জানি না। অথচ আমরা “কমিটি” করে আলাদা হয়ে যাই! একবার ভাবুনতো এতে লাভ হয়েছে কার?
আলোচনা হোক। সব শ্রেণিপেশার লোক থাকুক। যেখানে ঘটনা, সেখানের মানুষজনকে ডাকা হোক। তারা তদন্ত করুক। তারপর উনারা থানা, জেলা, মানবাধিকার, রাষ্ট্রকে জানাক। সমাধান আসবেই। অন্যায় করার জন্যে শাস্তি যে পাওয়ার সে পাক। হোক সে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান। ঘটনাকে উল্টো পথে যেন কেউ না নিতে পারে তার জন্যে সচেতন হতে হবে আমাদেরকেই। আমরা যদি দায়িত্ববান না হই তাহলে রাষ্ট্র কার ওপর নির্ভর করবে? লেখক : ডাইরেক্টর, রেডিও ঢোল, ফাউন্ডার, দ্যা লাভলি ফাউন্ডেশন;।silvia.parveen@gmail.com