বা আ॥ গত ১৯ মে ‘খেলোয়াড় বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন’ শিরোনামে সমকালে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। সেই লেখায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুই প্রজন্ম অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর পিতা এবং বঙ্গবন্ধুর নিজের ক্রীড়া কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার খানিকটা বিবরণ ছিল। ওই লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, সেই ১৯৪০ সালে গোপালগঞ্জের অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান খেলাধুলা, বিশেষ করে ফুটবলের প্রতি কতটা তীব্র অনুরাগী কিংবা ডেডিকেটেড ছিলেন। বঙ্গবন্ধু একাধারে ক্রীড়া সংগঠক আবার নিজে খেলোয়াড়ও ছিলেন। তিনি গোপালগঞ্জ তথা ফরিদপুর এলাকা ছাড়াও ‘৪০-এর দশকে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ঢাকায় গিয়েও ফুটবল খেলেছেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে শেখ পরিবারের বিচরণ শুধু শেখ লুৎফর রহমান ও বঙ্গবন্ধু- এই দুই প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং ফুটবল ছাড়াও ক্রীড়ার নানাবিধ শাখায় যুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ছিলেন ক্রিকেট, বাস্কেট বল, ফুটবল ও অ্যাথলেটিকসে পারদর্শী খেলোয়াড় ও সংগঠক। স্বাধীনতার পর তিনি আবাহনী ক্রীড়া চক্র গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা ক্রিকেট লীগ চ্যাম্পিয়নে আবাহনী দলের ওপেনিং বোলার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এ সময় তিনি সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দ্রুততম মানবও হয়েছিলেন। তিনি এ সময় ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের বাস্কেট বল খেলোয়াড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের ক্রিকেট খেলোয়াড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ব্যাডমিন্টনে (দ্বৈত) রানার্সআপ প্রভৃতি পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন। শেখ কামাল এ সময় ফুটবলও খেলতেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল খেলোয়াড় সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ক্রীড়া সংগঠক এবং আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শেখ কামালের অবস্থান সবারই জানা। শেখ কামাল যেমন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন, তেমনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বুয়েট মাঠে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ফুটবল দলের মধ্যে এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজনের অন্যতম উদ্যোগী ছিলেন। এখনকার দিনে ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে এমন উদ্যোগের কথা কি ভাবা যায়?
১৯৭৫ সালে শেখ কামালের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে শেখ পরিবারের পুত্রবধূ হয়ে আসেন সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যতিমান ক্রীড়াবিদ দেশসেরা অ্যাথলেট সুলতানা কামাল। তিনি ছিলেন প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিকস- ‘৭৩-এর ‘গার্ল অব দ্য মিট’। তাকে বলা হতো ‘গোল্ডেন গার্ল’। তার প্রিয় ইভেন্ট ছিল ১০০ মিটার দৌড়, হাইজাম্প, লংজাম্প, ১০০ মিটার হার্ডল্স। রোকেয়া হল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়ায় তিনি ছিলেন একাধিকবারের চ্যাম্পিয়ন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তান প্রাদেশিক গেমসেও রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জয়ের কৃতিত্ব ছিল তার। ১৯৭৩ সালে নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নয়াদিল্লিতে ব্রডজাম্পে ভারতীয় রেকর্ড ভঙ্গ করে পদক জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন সুলতানা কামাল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ‘ব্লু’ খেতাবধারী ক্রীড়াবিদ।
খেলাধুলায় বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের অংশগ্রহণও ছিল লক্ষণীয় এবং প্রত্যক্ষ। ১৯৭২ সালে তিনি আবাহনী ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ফুটবল খেলেছিলেন। পাশাপাশি তিনি ক্রিকেটারও ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত তফাজ্জল হোসেন স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় তার দলের নাম ছিল শেখ জামাল একাদশ দল। ১৯৭২ সালে জার্মানিতে মিউনিখ অলিম্পিকের সময় খেলা দেখতে তিনি জার্মানি গিয়েছিলেন। খেলাধুলার প্রতি শেখ জামালের অদম্য আগ্রহের কথা আমরা এভাবে বুঝতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনারও দুর্বলতা রয়েছে খেলাধুলার প্রতি। সম্ভবত সে কারণেই তিনি বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্ট উপভোগ করতে মাঝেমধ্যে স্টেডিয়ামে ছুটে যান। মাঠে না যেতে পারলে টিভির পর্দায় যে তার চোখ থাকে, তা বোঝা যায় যে কোনো খেলায় বাংলাদেশ দলের জয়ের খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিনন্দন জানানোর মধ্য দিয়ে। পত্রপত্রিকার পাতায় দেখেছি কিংবা তিনি নিজে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, সুযোগ পেলে তিনি নিজে ও তার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেন। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বা প্রায়শ তাকে ক্যারম খেলায় অংশ নিতে হয়।
খেলাধুলার প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহ ও মমত্ববোধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলাম ২০১৫ সালে। বাংলাদেশ ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট দলের সদস্যদের ভারতকে হারিয়ে দেশে ফেরার পর তার দপ্তরে নিয়ে তার উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন। প্রায় দুই ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, তিনি যেন সেদিন এ দলটির অভিভাবকত্বই গ্রহণ করেছিলেন। তার শুভেচ্ছা নিয়েই বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ক্রিকেট তথা অন্যান্য খেলাধুলা দিন দিন এগিয়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা ও পৃষ্ঠপোষকতা অনস্বীকার্য। ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রজন্ম পরম্পরায় শেখ পরিবারের অদম্য এ আগ্রহ যেন তারই ধারাবাহিকতা।
লেখকঃ অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়