হামিদুল আলম সখা॥ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। গোপালগঞ্জ এর টুঙ্গিপাড়ায় একটি হেলিকপ্টার এলো বিকট আওয়াজ তোলে। গ্রামবাসি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে। জলপাই রঙের পোশাক পড়া সৈন্য। মনে হচ্ছিল আবারও একাত্তর এসেছে শকুনের থাবা দিতে। টুঙ্গিপাড়ার মানুষ ভাবেনি তাদের প্রাণের মানুষকে এভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাবে। চারদিকে আতংক বিরাজ করছে। উচ্চ স্বরে কেউ কথা বলছে না। চুপিচুপি, ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। ওরা এসেই দেখলো ইনফরমেশন অনুযায়ী কবর খোঁড়া হয়েছে। এখন কবর দিলেই কাজ শেষ। গ্রামের মসজিদের ইমাম এগিয়ে এলেন। তার আবার ভয় কি? সেনা কর্মকর্তাদের বললেন কবর দেয়ার আগে দুটি কাজ করতে হবে। এক লাশটাকে গোছল করানো এবং দ্বিতীয়ত জানাজা পড়ানো। আপনারা নিশ্চয়ই মুসলমান। ধর্মীয় নিয়ম আপনাদের জানা উচিত। সেনা সদস্যরা তড়িঘড়ি করতে চায়। ইমাম সাহেবের কথা শুনে কিছুটা নরম হলো।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সারা বাঙালির জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ তিতিক্ষা, জীবনের সুখ শান্তি বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। জীবনের অর্ধেক সময় কারাগারে অন্তরীণ থেকেছেন। নিজের সুখের কথা কখনো ভাবেননি। যার জন্য আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখন্ড, লাল সবুজের পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত। সেই নেতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা সেনাবাহিনীতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা বাংলার কু সন্তানেরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। আর সেই নেতাকে কবর দিতে চেয়েছে বিনা গোছলে এবং বিনা জানাজায়।গা শিউরে উঠে।
দুই:
অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় তার বাবা মার কবরের পাশে কবর দেয়া হলো। কিন্তু ১৫আগষ্ট ঘাতকরা বেগম মুজিবসহ পরিবারের অন্য লাশগুলো ঢাকার বনানী গোরস্থানে দাফন করা হলো। কেন শুধু মাত্র বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নেয়া হলো? এ কথাটি কেউ ভেবেছেন? বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ঐ পাকিস্তানের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস সহ্য করতে পারে নি। ওরা মনে করেছিল যদি বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দেয়া হয় তবে বঙ্গবন্ধুর নাম ঠিকানা মুছে যাবে। ভুলেও কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করবে না। অথচ ঘাতকরা জানে না। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে আছে বঙ্গবন্ধু।
তিন:
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ এর টুঙ্গিপারায় জন্ম নিলেন খোকা। সেদিনকার টুঙ্গিপাড়া আজকের মত ছিল না। চলাচলের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। অজপাড়া গাঁ বলতে যা বুঝায়। ছেলে বেলা থেকেই খোকা ছিলেন জন দরদি। একবার দেশে খুবই অভাব হলো। খোকা তাদের ধানের গোলা থেকে ধান দিয়ে দিলেন। বাবাকে জিজ্ঞেসও করলেন না। এই জনদরদী থেকেই অধিকার আদায়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন। স্কুলে পড়ার সময় শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথ আগলে ধরলেন। সেই দিনের সেই খোকা অর্থাৎ শেখ মুজিব বললেন, আমাদের স্কুলের হোস্টেলের ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি পরে। ছাদ ঠিক করে দেয়ার দাবি জানান। সেদিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলে একদিন বড় রাজনৈতিক নেতা হবে। এর পর শেখ মুজিবুর রহমানকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। প্রতিবাদ করলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বললেন, আমাদের রাষ্ট্র ভাষা হবে বাংলা।
চার:
জনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জেলাখানায় থেকে অনসন করে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন করেন। ১৯৫২ সালের ২১ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ। মিছিলে গুলি হলে শহীদ হন সালাম, রফিক, শফিক, বরকতসহ নাম না জানা অনেকেই। রক্তের স্রোতে রাজপথ রঞ্জিত হলো। বীর বাঙ্গালীর দামাল ছেলে-মেয়েরা ভাষায় যুদ্ধে জয়লাভ করলো। বাঙালি জাতির জীবনে শুরু হলো জয়যাত্রা। এর পর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান এর সামরিক শাসন জারি, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, সর্বপরি শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬দফা। সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম এর পর ১৯৬৯ সালে গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলেন। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ জনাকীর্ণ এক ছাত্র সমাবেশে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন।
পাঁচ:
১৯৭৫সাল। ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন। প্রস্ততি চলছিল বেশ আগে থেকেই। বঙ্গবন্ধুর জৈষ্ঠ্য পুত্র শেখ কামালের নেতৃত্বে আয়োজন সম্পন্ন করতে বেশ রাত হয়েগিয়েছিল। তবুও শেখ কামাল ৩২ নাম্বার নিজ বাড়িতে ফিরলেন। সে রাতে শেখ কামাল যদি বন্ধুদের সাথে হলে থেকে যেতেন! তাহলে হয়ত সেই নরঘাতকদেও বুলেট তাকে বিদ্ধ করতে পারতো না এবং ইতিহাসের নতুন মোড় পরিলক্ষিত হয়ত। নিয়তির কাছে হেরে গেছে বাঙালি, বাংলাদেশ। সেদিন খন্দকার মুশতাক এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু সহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। তারা বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, যুবলীগের প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করে।
শেখ রাসেল ১০-১২ বছরের শিশু। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র। তাকেও ঘাতকরা ছাড়েনি। রাসেল ঘাতকদের কাছে আকুতি করেছিল, আমাকে তোমরা মেরো না। আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।” ততক্ষনে বেগম মুজিব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। হায়রে নিয়তি মায়ের লাশ দেখে রাসেলের ছোট্ট মন কেমন হয়েছিল তা পরম করুণাময় জানেন। এরপর ঘাতকরা শেখ রাসেলকে মায়ের মৃত দেহের উপর ফেলে ব্রাস ফায়াার করে ছোট্ট প্রাণটি নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিল। হায়রে পাপিষ্ঠ ঘাতক। ধিক, তোদের ধিক!
ছয়:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন জঘন্যতম, পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ কোথাও হয়নি। সেদিন ভোরে একদিকে মোয়াাজ্জেম ফজরের নামাজের আজান দিচ্ছিল অন্যদিকে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র হত্যাযজ্ঞ করছিল আর আনন্দ উল্লাসে পৈশাচিক কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিল।
দুই নববিবাহিত পুত্রবধুু, নারী, শিশু, সিনিয়র সিটিজেন কেউ রক্ষা পায়নি। সেই বিভিষিকাময় ভোরে বাংলাদেশ বেতার এ ঘোষণা এলো “আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে——————। সমস্ত বাঙালি থমকে গিয়েছিল। কারো চোখে জল ছিল না। কারো মুখে কথা ছিল না। প্রতিবাদের ভাষা ছিল না। তবুও ময়মনসিংহ এলাকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আর স্বাধীনতা বিরোধী চক্র উল্লাসে পৈশাচিক উন্মাদনায় মত্ত হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু দুই কন্যা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যায়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে। প্রতিটি বাঙালির জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান নিশ্চিত চেয়েছিলেন। তাই তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর জৈষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হন। এর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এর ঘাতক, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ বিচারের আওতায় এনে সবোর্চ্চ শাস্তি ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এখনো এই দুই টি মামলার আসামি বিদেশে পলাতক রয়েছে। তাদেরকে ইন্টারপুলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করলে দেশ কলঙ্ক মুক্ত হবে।
ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দিয়েছে। সুজলা সুফলা সোনার বাংলার ছায়াা সুনিবিড় গ্রামে বাবা মার কবরের পাশে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শায়িত আছেন।
পিতা তুমি শান্তিতে ঘুমাও; তোমার কন্যা আমাদের জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; আকাশচুম্বী সাহস নিয়ে তোমার রেখে যাওয়া কাজ সমাধা করে ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করাই একমাত্র লক্ষ্য।