প্রশান্তি ক্রিয়া প্রতিবেদক॥ রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরও মাঠে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ছেলেটি। নিজের গায়ে ছিমটি কেটে দেখলো, স্বপ্ন নাতো! পরক্ষণে বুঝলো, না এটা স্বপ্ন নয় বাস্তব। গ্যালারির দিকে তাকিয়ে দেখলো, তার মা-বাবা আনন্দে চোখের পানিই ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে মাঠ ছেড়ে উঠে এলো ১৬ বছর ২৯৮ দিন বয়সী আনসু ফাতি। বার্সেলোনার ইতিহাসে দ্বিতীয় সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে লা লিগায় অভিষেক ঘটে গেলো এখনও কৈশোর না পেরুনো আফ্রিকান গিনি বিসাউয়ে জন্ম নেয়া কৃষ্ণ বর্ণের ছেলেটি। মাঠে নামার আগেই কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে গিয়েছিল আনসু ফাতিহের জীবনে! গ্রহের সেরা ফুটবলার বলা হয় যাকে, বার্সেলোনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি এসে অভিনন্দন জানালেন কিশোর ছেলেটিকে। বুকে জড়িয়ে নিলেন। অভয় দিয়ে বলে দিলেন, ‘সংগ্রামমুখর দিনগুলো শুরু হয়ে গেলো তোমার। আমাকে দেখো! ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বুক চিতিয়ে খেলে যাও। সাফল্য এমনিতেই এসে তোমার পায়ে লুটোপুটি খাবে।’ মেসির কথাগুলো কাল্পনিক। কিন্তু ইতিহাসের ব্যাটন বুঝি এভাবেই হাত বদলায়! পরিস্থিতিটা একটু পর্যালোচনা করে দেখুন! মেসির বয়স এখন ৩২। ক্যারিয়ারটা আর কতদুর লম্বা করবেন? বড়জোর ৪ বছর! এরপর তো কাউকে না কাউকে নিজের ব্যাটনটি দিয়ে যেতেই হবে। ১৬ বছর বয়সী আনসু ফাতিকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে কি মেসি সেই কাজটিই অলক্ষ্যে করে দিয়ে গেলেন কি না! ২০০৪ সালের কথা চিন্তা করুন। আজকের মেসির জায়গায় ছিলেন রোনালদিনহো। মেসি নিজেই একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বার্সায় অভিষেকের দিন ড্রেসিং রুমেই কেন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। কিন্তু রোনালদিনহো আমাকে কাছে টেনে নিলেন। অভয় দিলেন।’
বার্সার পতাকা বয়ে বেড়ানো রোনালদিনহো সেদিনই মেসির হাতে তুলে দিয়েছিলেন লা বলুগরুনাদের নিশান। এরপর ধীরে ধীরে মেসি হয়ে উঠলেন আজকের বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান, সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। সময় বড়ই নিষ্ঠুর। আজকের মেসিকেও একদিন বিদায় নিতে হবে। তার জায়গা নেবে আনসু ফাতি। এরপর কালের আবর্তে আনসুদেরও বুট তুলে রাখতে হবে। আসবেন অন্য কেউ। গতিময় পৃথিবীতে এটাই নিয়ম।
বার্সেলোনার ফুটবলার তৈরির কারখানা লা মাসিয়া। যেখান থেকে মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তারা গড়ে উঠেছিলেন। ১০ বছর বয়সে সেই লা মাসিয়াতেই ভর্তি হয়েছিলেন আনসু ফাতি। ৬ বছর বয়সে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গিনি বিসাউ থেকে বাবার সঙ্গে স্পেনে চলে আসেন ফাতি। বসবাস শুরু করেন সেভিয়ার হেরেরাতে। ছোট্ট বয়সেই যেভাবে ফুটবল নিয়ে তার স্কিল দেখাতে শুরু করেন, তখনই ফাতিকে পেতে উঠেপড়ে লাগে স্পেনের বড় বড় ক্লাবগুলো। সেভিয়া, রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করেই ফাতিকে লা মাসিয়ায় নিয়ে আসে বার্সা কর্মকর্তারা।
আনসু ফাতির বাবা বোরি ফাতি মিডিয়াকে জানিয়েছেন, রিয়াল মাদ্রিদ বার্সার চেয়েও বেশি টাকা দিতে চেয়েছে তাদের। কিন্তু বার্সা কর্মকর্তারা তার বাড়িতে চলে যান এবং তাকে বোঝাতে সক্ষম হন, আনসুর ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য লা মাসিয়াই উপর্যুক্ত। যে কারণে, ২০১২ সালে তিনি শেষ পর্যন্ত ছেলেকে পাঠিয়ে দেন লা মাসিয়ায়। সেই লা মাসিয়ায় গত ৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে গড়ে উঠছেন আনসু ফাতি। এরই মধ্যে নজর কেড়ে নিয়েছেন সবার। বার্সার বয়সভিত্তিক দলগুলোর সেরা একাদশে তো অটোমেটিক চয়েজ গিয়েছিল ফাতি। নিজে গোল করা, গোল করানো তো নিয়মিত অভ্যাস। তার অসাধারণ স্কিল, ড্রিবলিং, গতি- ফুটবলের এমন কোনো কৌশল নেই যা এই অল্প বয়সে রপ্ত করে ফেলেনি আফ্রিকান ছেলেটি।
মাদ্রিদ ভিত্তিক বিখ্যাত ক্রীড়া দৈনিক মার্কা আনসু ফাতির ছোট্ট এই ক্যারিয়ারকে বর্ণনা করছে, ‘ইলেক্ট্রিক ক্যারিয়ার’ হিসেবে। সঙ্গে এটাও জানিয়ে দিয়েছে, দ্য লেটেস্ট লা মাসিয়া জুয়েল (লা মাসিয়ার সর্বশেষ রত্ন)। বার্সার ক্লাব একাডেমি লা মাসিয়ায় যেভাবে সে বেড়ে উঠছে, তাতে তাকে রত্ন না বলে উপায় নেই। সেই রত্নটাকে খাঁটি জহুরির মত খুব সহজেই চিনে নিলেন বার্সা কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে। মৌসুমের দ্বিতীয় এবং ন্যু ক্যাম্পে প্রথম ম্যাচ রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে। আগের ম্যাচে অ্যাথলেটিকো বিলবাওয়ের কাছে হারের কারণে ন্যু ক্যাম্পের ম্যাচটি ছিল বার্সার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এমন ম্যাচেই কি না ইনজুরির জন্য নেই মেসি, সুয়ারেজ এবং ওসমান ডেম্বেলে। কি করবেন ভালভার্দে? উপায়ান্তর না দেখে তিনি চোখ দিলেন বার্সার ‘বি’ টিম এবং লা মাসিয়ার দিকে। সেখানে তো প্রস্তুুত ছিলই আনসু ফাতি। ‘বি’ টিম থেকে নিয়ে এলো চার্লস পেরেজকে। ভালভার্দে যখন লা মাসিয়ায় খবর পাঠালেন, আনসু ফাতিকে সিনিয়র দলে রাখা হচ্ছে। তখন তো কথাটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না তার বাবা বোরি ফাতি এবং মায়ের।
রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে সবচেয়ে সুখের দিন এটি। গতকাল (ম্যাচের আগেরদিন, শনিবার) যখন ফাতি এসে আমাকে বললো, ভালভার্দে তাকে সিনিয়র দলে ডাক দিয়েছেন, কথাটি কেন যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কিন্তু আনন্দে আমি আর আমার স্ত্রী কেঁদে ফেলেছিলাম। এমন একটি স্বপ্নই তো আমরা দেখে এসেছিলাম এতদিন।’ রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে চার্লস পেরেজের পরিবর্তে শেষ মুহূর্তে মাত্র ১০ মিনিটের জন্য আনসু ফাতিকে মাঠে নামিয়েছিলেন কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে। তিনি যখন মাঠে নামছিলেন, ন্যু ক্যাম্পও উঠে দাঁড়িয়ে অভিভাদন জানালো বার্সার ভবিষ্যৎ তারকাকে। মাঠে নামার পরও নিজের কাছে স্বপ্ন মনে হয়েছিল ফাতির। ম্যাচ শেষে মাঠে দাঁড়িয়ে শুধু তাকাচ্ছিলেন গ্যালারিতে মা-বাবার দিকে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার মা-বাবার দিকে তাকাচ্ছিলাম। পরিবারের অন্য সদস্যদের দিকেও। এছাড়া যারা আমার সাথে গ্যালারিতে এসেছিল তাদের দিকেও। এখন এই সময়টা শুধু উদযাপন করার। সবার কাছে তখন আমি যেন হয়ে উঠেছিলাম এক একটি প্রশংসা বাক্য।’ বার্সেলোনা এই রতœ হারাতে চায় না। এ কারণে তার মূল্য নির্ধারণ করে ফেলেছে আকাশছোঁয়া। গত জুলাইতেই বার্সা তার সঙ্গে ২০২২ সাল পর্যন্ত পেশাদার চুক্তি করে ফেলেছে। এবং চুক্তির পর মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ফাতির রিলিজ ক্লজ বার্সা নির্ধারণ করে ফেলেছে ১০০ মিলিয়ন ইউরো (এক হাজার কোটি টাকা)।
মেসির পরবর্তী সময়ে বার্সার তারকা হিসেবে যাকে গড়ে তোলা হচ্ছে, তাকে তো ছেড়ে দিতে চাইবে না বার্সা- এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে মাত্র ১০ মিনিট ফুটবল খেলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে গেলেন ফাতি। ইনস্টাগ্রামে ম্যাচের আগে তার ফলোয়ার ছিল মাত্র ৬৪ হাজার। আর ম্যাচের পর সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখে। জ্যামিতিক হারে ফলোয়ার সংখ্যা কেবল বাড়ছেই।