তিনশ কোটি টাকা ফেরত চায় হলমার্ক গ্রুপ

প্রশান্তি ডেক্স॥ জব্দকৃত তিনশ’ কোটি টাকা ফেরত চায় ব্যাংক জালিয়াতির হোতা হলমার্ক গ্রুপ। নতুন করে ব্যাংকিং সুবিধাসহ সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছে। সম্প্রতি হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত আইনি কর্মকর্তা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে লিখিত এ প্রস্তাব দেন। যদিও সরকারও চাচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে হলমার্ক গ্রুপের কারখানার চাকা সচল করতে। এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর হলমার্কের কাছে ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের পাওনা আদালতের বাইরে সমঝোতার ভিত্তিতে আদায়ের কৌশল খুঁজতে উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে খেলাপি ঋণ নবায়ন করে নতুন ঋণের জন্য আবেদন করেছে হলমার্ক গ্রুপ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে হলমার্কের বন্ধ থাকা কল কারখানা, খামার ও সম্পত্তি পরিদর্শন করা হয়েছে। সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রীকে দেয়া হলমার্ক গ্রুপের সাত দফা দাবির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হবে। এর বিনিময়ে প্রথম শর্ত হচ্ছে হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও এমডি তানভীর মাহমুদকে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডি জেলহাজতে থাকার সময় হলমার্কের অ্যাকাউন্টে ৪৬৫ কোটি টাকা জমা দেয়া হয়েছে। ওই টাকা থেকে কমপক্ষে তিনশ’ কোটি টাকা ব্যবসা পরিচালনার জন্য গ্রুপকে ফেরত দিতে হবে। চেয়ারম্যান ও এমডি অর্থমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক ব্যাংকঋণ পরিশোধ করবেন। পাশাপাশি জামিনে মুক্ত হওয়ার পর এ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় সম্পত্তির তালিকা অর্থমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। তৃতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে হলমার্কের ৯০ থেকে ১০০ কোটি টাকা জমা আছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ আদালত কর্তৃক অবরুদ্ধ করা আছে। এ গ্রুপ যেন ব্যবসা পরিচালনা করে ঋণ পরিশোধ করতে পারে সেজন্য অবরুদ্ধ অর্থ অবমুক্ত করতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে বলা হয়, জনতা ব্যাংকের ম্যাক্স স্পিনিং মিলস ও আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের হিসাবে জমাকৃত ৮৩ কোটি টাকা হলমার্কের পাওনা। এ অর্থ হলমার্ক গ্রুপকে ফেরত দিতে হবে। পঞ্চম প্রস্তাবে বলা হয়, ঋণের টাকা সহজে পরিশোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কিস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ষষ্ঠ প্রস্তাবে বলা হয়, গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি জামিনে মুক্তিলাভের পর দ্রুত জমি বিক্রি করে ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন। সপ্তম প্রস্তাবে বলা হয়, হালমার্ক সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনা, গ্রাহকদের পূর্ণবিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারে এজন্য সব ধরনের ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করতে হবে। লিখিত প্রস্তাবে তানভীর মাহমুদের আইনি কর্মকর্তা বাবুল ইসলাম বলেন, হলমার্ক গ্রুপের এমডির ক্ষমতা প্রাপ্য হয়ে আপনাকে (অর্থমন্ত্রী) জানাচ্ছি এ গ্রুপের এমডি বিগত সাত বছরের বেশি সময় জেলহাজতে আছেন। চেয়ারম্যানও দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন। চেয়ারম্যান ও এমডির অবর্তমানে গ্রুপের ৪৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ। প্রায় ৪০ হাজার কর্মচারী বেকার। মেশিনারিজ কার্যকর না থাকায় প্রায় ধ্বংসের পথে। এখন চেয়ারম্যান ও এমডি জামিনে বের হতে পারলে এ গ্রুপ ঘুরে দাঁড়াতে এবং বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, ‘হলমার্ক টাকা দিয়ে ব্যবসায় ফিরে আসবে। আমি নতুন করে ব্যবসায়ী সৃষ্টি করতে পারব না। সুতরাং তাদের দিয়েই ব্যবসা করাতে হবে। আমি চাচ্ছি, আমাদের ব্যাংকঋণ পরিশোধ করবে। ব্যবসা করতে হলে পাওনা শোধ দিতে হবে। তাদের সে সক্ষমতা আছে।’ জানা যায়, এর আগেও চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি আবেদন করেছিলেন কারাবন্দি তানভীর মাহমুদ। সেখানে তিনি বলেছেন, তাকেসহ তার স্ত্রী জেসমিন ইসলামকে জামিনে মুক্তি দেয়া হলে কারখানা চালু করে প্রথম বছর ১২ কোটি, দ্বিতীয় বছর ২৪ কোটি ও তৃতীয় বছর থেকে ১০০ কোটি টাকা করে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করবেন। এদিকে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়া হলমার্ক গ্রুপের সাভারের কারখানাগুলোর সব মেশিনারি, সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে। রাতের আঁধারে ভারী মেশিনপত্র চুরি হয়ে যাচ্ছে। কারখানার ভেতরে জন্মেছে ঘাস, গাছপালা। কোথাও কোথাও গবাদি পশুর খামার গড়ে তুলেছে একটি পক্ষ। এদিকে অনিশ্চয়তা আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আদায় নিয়ে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকা আদায়ের গ্রহণযোগ্য কোনো পথই খুঁজে বের করতে পারেনি। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতাউর রহমান প্রধান ভোরের কাগজকে বলেন, আমি অল্প কিছুদিন আগে ব্যাংকটিতে দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি বেশ জটিল ও পুরনো। কতগুলো মামলাও চলছে। তবে টাকা একদিন না একদিন ফিরে পাবেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলে তিনি বিশ্বাস করেন। জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের তদন্তে হলমার্কের এক হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কারখানার মেশিনপত্র, ভবন ও জমি রয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত প্রায় আট বছরে আদায় করেছে ৫০০ কোটি টাকার মতো। বাকি টাকা এখনো অনাদায়ী। ২০১১-১২ সালে হলমার্কের কাছ থেকে যেসব দামি গাড়ি জব্দ করা হয়েছিল সেগুলোরও হদিস নেই এখন। সোনালী ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে দুর্বলতার বিষয় হচ্ছে হলমার্ককে যে টাকা দেয়া হয়েছে তার বৈধ কোনো কাগজপত্রই নেই ব্যাংকের কাছে। অর্থাৎ সেগুলো আদৌ ঋণ হিসাবে গেছে কিনা, তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। ফলে হলমার্কের কারখানার কোনো ভবন ও যন্ত্রপাতি বন্ধকী হিসেবে দেখাতে পারছে না সোনালী ব্যাংক। শুধু জমি বন্ধকী হিসেবে নিয়েছে। ফলে ব্যাংক ইচ্ছা করলেও বন্ধক নেই এমন সম্পদের ওপর নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এদিকে নিজেদের আনসার না থাকায় কারখানার ভবন ও যন্ত্রপাতি খোয়া গেলেও সোনালী ব্যাংক কিছুই করতে পারছে না। সম্প্রতি আবার ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেছে হলমার্ক গ্রুপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.