প্রশান্তি ডেক্স ॥ গত মঙ্গলবার কাঠমান্ডুর ১৩তম এসএ গেমসে কারাতে ডিসিপিস্ননের ছেলেদের বিভাগে সোনা জিতেছেন আল আমিন। মেয়েদের বিভাগে মারজানা আক্তার প্রিয়া ও হোমায়রা আক্তার অন্তরা। ছবিতে জাতীয় পতাকা হাতে তারা তিনজন। কাঠমান্ডুর ১৩তম এসএ গেমসে কারাতে ডিসিপিস্ননে সাফল্যের হাসি হেসেছে বাংলাদেশ। গত মঙ্গলবার একইদিনে এই ডিসিপিস্নন থেকে এসেছে তিনটি সোনা। ছেলেদের বিভাগে আল আমিন দেশকে দ্বিতীয় সোনা জিতিয়ে আনন্দে ভাসিয়েছেন প্রথমে। পরে মেয়েদের বিভাগে মারজানা আক্তার প্রিয়া তৃতীয় ও হোমায়রা আক্তার অন্তরা চতুর্থ সোনা জিতে উপলক্ষটার বিশেষত্ব আরও বাড়িয়ে দিলেন। কাঠমান্ডুর সাতদাবাতোর ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস কমপেস্নক্সে মঙ্গলবার পুরুষ একক অনূর্ধ্ব-৬০ কেজি ওজন শ্রেণিতে পাকিস্তানের জাফরকে ৭-৩ ব্যবধানে হারিয়ে সেরা হন আল আমিন। সেমি-ফাইনালে নেপালের প্রতিযোগীকে ৭-৪ ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সি এই কারাতেকা। সোনা জয়ের উচ্ছ্বাসে ভাসলেও কারাতে শুরুর কঠিন দিনগুলো নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করলেন আল আমিন। জানালেন, কিভাবে জড়িয়ে পড়লেন খেলাটির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কারাতেতে আসার পেছনের কারণ আমার ছোট চাচা (শরিফুল ইসলাম), তিনি কারাতের প্রশিক্ষক ছিলেন। ছোট বেলায় তিনি আমাদের হাত ধরে নিয়ে আসতেন কারাতে শেখানোর জন্য। তখন মন চাইত না কিন্তু চাচা ধরে পেড়ে নিয়ে আসতেন। একটু মারধরও করতেন। এভাবেই কারাতেতে আসা। প্রথম প্রথম কষ্ট ছিল। কেননা, আমি আগ্রহী ছিলাম না। এরপর জেলায় খেলতে গেলাম, ভালো করলাম। কারাতে ভালো লাগতে শুরু করল। এভাবেই খেলাটিকে ভালোবেসে ফেললাম।’ গত নভেম্বরেই ঢাকায় হয়েছিল সাউথ এশিয়ান কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপ। সেখানেও সোনা জিতেছিলেন রাজশাহী থেকে উঠে আসা আল আমিন। এরপর কাঠমান্ডুতেও নোঙর ফেলেছিলেন দেশকে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে। তিনি বলেন, ‘সাউথ এশিয়ান কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছিলাম, সেখান থেকে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। সেখানে বাইরের যারা খেলেছিল, তাদের অনুশীলন, কৌশলগুলো খুব অনুসরণ করেছিলাম। সেগুলো নিজে চেষ্টা করতাম। কোচও অনেক অনুশীলন করিয়েছেন।’ যখন দেশ থেকে আসি, অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম। নিজের ওপর ভরসা ছিল, দেশের জন্য কিছু করতে পারব। রাতে নিজের মতো করে অনুশীলন করেছি। ফাইনালের মঞ্চে ওঠার আগে কোচ পাকিস্তানের প্রতিযোগীর কিছু মুভমেন্টের ব্যাপারে বলেছিলেন। কৌশলও বলে দিয়েছিলেন। সেটা অনুসরণ করলাম। কোচ আরও বলেছিলেন দেখ- দেশের সম্মানটা যেন রক্ষা করতে পার। আমি পেরেছি।
‘এই আবেগ আসলে বলে বোঝাতে পারব না। আমার ভেতরে অনেক কিছু হচ্ছে। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য আমি কিছু নিয়ে আসতে পেরেছি, বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা তুলে ধরতে পেরেছি, এজন্য গর্ববোধ করছি। ‘বিস্ময়’ প্রিয়ার হাত ধরে তৃতীয় সোনা রঙ-তুলির কোনো প্রতিযোগিতায় মারজান আক্তার প্রিয়া সেরা হলে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়া মেয়েটি কি না দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সেরা হলো কারাতের কুমিতে! মারামারির খেলায়!
কাঠমান্ডুর সাতদাবাতোর ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস কমপেস্নক্সে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-৫৫ কেজি ওজন শ্রেণিতে গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের কৌসরা সানাকে ৪-৩ পয়েন্টে হারিয়ে সোনা জিতেন প্রিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরে প্রথমবারের মতো পরেন সেরার মুকুট। বাংলাদেশকে এনে দেন তৃতীয় সোনা জয়ের আনন্দে ভেসে যাওয়ার উপলক্ষ। ঠোঁটে, চোয়ালে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে প্রিয়া যখন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন, মুখে কেবলই প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস, ব্যথার ছিটেফোঁটাও নেই। জানালেন, বাংলাদেশ পুলিশে এসআই পদে চাকরি করা বাবা কিভাবে প্রতি-ক্ষণে দেশের জন্য কিছু করার তাগাদা দিতেন মেয়েকে। প্রিয়া বলেন, ‘এই অনুভূতি আসলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আজ যতটা খুশি, এতটা খুশি আমি কখনও হইনি। এটা আমার জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, কেননা তার ইচ্ছাতেই আমি আজ এখানে।’ পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার বাবা-মাকে, খেলোয়াড়দেরকে। আমার কাছে বাবার প্রত্যাশা ছিল, দেশের জন্য সোনা নিয়ে আসি, গতকালও ফোনে তিনি আমাকে এটা বলেছিলেন। মাত্র তিন বছর আগে কারাতে শুরু করেছিলেন প্রিয়া। দ্রম্নতই উঠে বসলেন অর্জনের চূড়ায়। ১৯ বছর বয়সি এই অ্যাথলেটের দৃষ্টি এখন দলগত ইভেন্ট নিয়ে। তিনি বলেন, মাত্র তিন বছর আগে আমি কারাতে শুরু করি। ভারত, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়ার কিছু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু এর কোনোটাই এসএ গেমসের মতো বড় মঞ্চ ছিল না। হঠাৎই কারাতেতে এসেছিলাম। গত জাতীয় মিটে রুপা পেয়েছিলাম। এসএ গেমসে প্রথম সোনা জিতলাম। কাল আমাদের দলগত ইভেন্ট আছে। চতুর্থ সোনা অন্তরার কারাতের নারী একক প্রতিযোগিতা থেকে চতুর্থ সোনার পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। নেপালের প্রতিযোগীকে উড়িয়ে কুমিতে সেরা হয়েছেন হোমায়রা আক্তার অন্তরা। পেলেন অনেক ত্যাগ স্বীকারের ফল। কাঠমান্ডুর সাতদাবাতোর ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস কমপেস্নক্সে গত মঙ্গলবার নারী একক অনূর্ধ্ব-৬১ কেজি ওজন শ্রেণিতে নেপালের অনু গুরুংকে ৫-২ পয়েন্টে হারান অন্তরা। এসএ গেমসের ক্যাম্পের জন্য এবার বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেননি অন্তরা। তবে সোনা জিতে সব দুঃখ ভুলে যাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি যখন থেকে কারাতে শুরু করেছি, তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জয় করা। এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি এ খেলাটার জন্য অনেক সেক্রিফাইস করেছি। ভার্সিটির পরীক্ষা ছিল সেটা মিস করেছি, মেডিকেল পরীক্ষাও দিতে পারিনি। কারণ ক্যাম্পে ছিলাম। হয়তো ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারতাম। সেই স্বপ্নটা আমার এ বছর পূরণ হয়নি। তবে আগামীতে অবশ্যই চেষ্টা থাকবে।’ তিনি বলেন, যখন ম্যাটে উঠি, তখন আমার দেশের পতাকার কথা মনে হয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীত বাজবে। আমি চেয়েছি দেশের পতাকা উপরে তুলতে। ‘২০১০ সালে বিপাশা আপুরা যখন পদক পায়, তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি কারাতে শেখার। আমার কাছে এ সাফল্যের কৃতিত্ব এককভাবে কারও কৃতিত্ব নয়, সবাই কষ্ট করেছে। বিশেষ করে আমার কোচরা, বাবা-মা, টিম অফিসিয়ালরা সবাইকে ধন্যবাদ। আমার চেয়ে বেশি স্বপ্ন তারা দেখেছে। তাই সবাই আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিল, সেই বিশ্বাস আমি পূরণ করতে পেরেছি তাতেই আনন্দিত।’