বা আ॥ গত ১১ বছরের আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আজ সব সূচকে অগ্রগতি, সাফল্য আর উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়েই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর যারা বলেছিল- বাংলাদেশ হবে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাসহ গোটা বিশ্বই বলছে- মাত্র এক দশকেই বাংলাদেশ উন্নয়নের বিস্ময়। গোটা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল আজ বাংলাদেশ। অতীতের মতো সরকারের গত এক বছরেও দেশের রাজনীতিসহ সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে।
সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপমন্ডুকতা, জঙ্গীবাদী দেশের কলঙ্ক ঘুচিয়ে বাংলাদেশ আজ পরিচয় পেয়েছে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-শান্তির সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকা উড়ছে আজ বাংলার ঘরে ঘরে। আর এই প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা গত এক
দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ক্লান্তিহীন পরিশ্রম, দেশপ্রেম, সততা-নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সঙ্গে দেশ পরিচালনার কারণেই বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থান সম্ভব হয়েছে। পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই তার কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের মহাসোপানে।
নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের জাল ছিন্ন করেই সব সূচকে অগ্রগতি, সাফল্য ও উন্নয়নের পায়রা উড়িয়েই গত মঙ্গলবার টানা তৃতীয় মেয়াদের ক্ষমতার প্রথম বছর পূর্ণ করে দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করছে ভূমিধস বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। ৩০ ডিসেম্বর রেকর্ডসংখ্যক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি তারুণ্যনির্ভর চমকের সরকার গঠন করেছিলেন টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী ঘোষিত ‘মুজিববর্ষ’ শুরুর প্রাক্কালে আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তার সরকারের প্রথম বছর সাফল্যসহ গত এগারো বছরে দেশকে বদলে দেয়ার চিত্র এবং আগামী চার বছরে দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনার কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবেন। এছাড়া আগামী ৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে মহাসড়ক দিয়ে দেশের উন্নয়নের মহাযাত্রার বাস্তব চিত্র তুলে ধরবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ।
মাত্র এক দশক আগেও দেশের চিত্র কী ছিল? বাংলাদেশের চিত্র এমন ছিল না। তখন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটত বড় একটি জনগোষ্ঠীর। অধিকাংশ ঘরবাড়ি ছিল মাটির দেয়াল অথবা পাটখড়ি বা বাঁশের বেড়া আর খড়ের ছাউনিতে তৈরি। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের সেই চিত্র আর নেই। মাত্র ১১ বছরেই পাল্টে গেছে দেশের সার্বিক দৃশ্যপট। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোও এখন রূপ নিয়েছে শহরের আদলে।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িঘর দাঁড়িয়ে আছে ইট-সিমেন্ট অথবা টিনের ওপরে। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের বাড়িতে জ্বলছে বিজলি বাতি। ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা গ্রামাঞ্চল থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়েছে বললেও ভুল হবে না। কাঁচা রাস্তাও এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। উত্তরবঙ্গে মঙ্গা নামক শব্দটি এখন ইতিহাস। বদলে গেছে তলাবিহীন ঝুড়ির কথিত ভাবমূর্তিও। জঙ্গী-সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিরাও পড়েছে অস্তিত্বের সঙ্কটে। নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে। টানা ১১ বছর ধরেই উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসোপানে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
টানা তৃতীয় মেয়াদসহ রেকর্ড সংখ্যক চার বার ক্ষমতায় থাকা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষ দেশের সার্বিক চিত্র পাল্টে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক এভাবেই। গত এক বছরে ঘরে-বাইরে নানা সঙ্কট মোকাবেলা করতে হলেও ষে পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজয়ের হাসি হেসেছে বর্তমান সরকারই। ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি যে সরকার দিন বদলের অঙ্গীকারের পানসিতে চড়ে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে সরকারের যাত্রা শুরু করেছিল, সে সরকারের গত ১১ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশের খেরো খাতা খুলে বসেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজসহ দেশের মানুষ।
আর সেই খেরো খাতায় উঠে এসেছে- টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা ১৪ দলীয় জোট সরকারের প্রথম বছরে মানুষের আশাভঙ্গ ঘটেনি, তবে আত্মতুষ্টিরও সুযোগ নেই। তবে তীর থেকে প্রত্যাশার তরী এখনও কিছুটা দূরে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান কমেছে দ্রুতগতিতেই। তবে রাজনীতির সামগ্রিক গুণগত পরিবর্তন এখনও দৃশ্যমান নয়। বর্তমান সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অটুট এবং জনপ্রিয়তার পারদ উর্ধগতি হলেও তাতে কিছুটা হলেও ভাটার টানা পড়েছে পেঁয়াজ সঙ্কটসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কিছু ব্যর্থতার কারণে।
বিশ্লেষকদের মতে, সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করলে গত এক বছরে বর্তমান সরকারের পাল্লা সফলতায় ভারি, তবে ব্যর্থতার পাল্লা কম হলেও গুরুত্বহীন নয়। সামগ্রিকভাবে সরকারের ওপর দেশের মানুষের আস্থা এখনও অটুট রয়েছে। সর্বোপরি মেয়াদ পূর্তির এক বছরের মাথায় মানুষ হিসাব মেলাতে চাইবে, সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করতে পেরেছে বা করেনি। তাদের আশাবাদ, বাকি মেয়াদের চার বছরে পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে, সরকার তাদের প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবে।
সরকারের মেয়াদ একবছর পূর্তিকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজচিন্তক বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অনেকটা এক বাক্যেই স্বীকার করেছেন, ১৯৯৬ বা ২০০১-এর শেখ হাসিনা এবং ২০০৮-এর শেখ হাসিনার মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। এখনকার শেখ হাসিনা অনেক বেশি সাহসী, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং নেতা হিসেবে ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত হয়েছেন। টানা তৃতীয় মেয়াদে এসেই দুর্নীতিবিরোধী কঠোর শুদ্ধি অভিযান, নিজের ঘরের বাঘা বাঘা নেতাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা, দলের অনেক বড় নেতা-মন্ত্রীদের দুদকের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ তল্লাশি, মামলা দায়ের ইত্যাদি নানা কঠোর পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বেই এখন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
সাফল্য-ব্যর্থতার বিচারে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা সরকারের এই প্রথম বছরে সাফল্যের পরিমাণ যে কয়েকগুণ বেশি, তা চরম সমালোচকরাও মানতে বাধ্য হচ্ছেন। সারাবিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা নেতাও এত স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি দেখে বিস্ময়ও প্রকাশ করছেন। আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম বছর পূর্তিতেও আওয়ামী লীগ সরকার রয়েছে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে।
বিগত এক দশকের মতো সরকারের প্রথম বছরেও রাজনীতিতে চালকের আসনে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় আজ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিজয়ের কেতন উড়াতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি।
দুর্নীতি-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের দেশের কালো তকমা মুছে ফেলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও জঙ্গীবিরোধী ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি শুধু দেশেই নয়, এখন সারাবিশ্বে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং নিজ ঘর থেকে শুদ্ধি অভিযানের সাহসী পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাসকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন, জঙ্গীবাদ দমন, আগের মতোই সংঘাত-সহিংস রাজনীতির বদলে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত, বেকারত্ব দূরীকরণ, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতাবিরোধী অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিরোধ, অর্থনীতির আরও গতি সঞ্চার, সংসদকে কার্যকর করে একটি শান্তিময় সমৃদ্ধশালী দেশ উপহার দিতে সরকারের সামনে মেয়াদের বাকি চার বছর অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই এসেছে। দলের মধ্যে থাকা অনৈক্য, বিভেদ ও দ্বন্দ্ব দ্রুত মিটিয়ে দলের সকল সাংগঠনিক শক্তিকে ইস্পাত কঠিন ঐক্যের বাঁধনে বাঁধাও বর্তমান সরকারের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
উগ্র ধর্মভিত্তিক-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আবারও বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে কিনা, দ্বিতীয় মেয়াদে এসে এ কঠিন সিদ্ধান্তটির নিষ্পত্তি করতে হবে সরকারকে। মাঝে মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাকারী জঙ্গীবাদী অপশক্তির শেকড় সমূলে উৎপাটন ও এদের নেপথ্যের গডফাদারদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর বিশাল চ্যালেঞ্জও রয়েছে সরকারের সামনে। তবে সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদেও জঙ্গীবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের পালিত সন্ত্রাসী-জঙ্গীদের মাথা তুলে দাঁড়াবার সম্ভাবনা কম।
সরকারের গত এক বছরে রাজনীতির মাঠ ছিল বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেকটাই শান্ত। গত এক বছরে রাজপথে আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে রাজপথে নামতেই পারেনি বিএনপি। ছিল না হরতাল কিংবা আগুনে পোড়া, বোমায় বিধ্বস্ত কোন শোকাতুর পরিবেশ। দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র শক্ত হাতে মোকাবেলা করে সৃষ্টির জাগরণে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় আজ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সরকারের টানা ক্ষমতার ১১ বছরে দেশের অনেক ইতিহাসই পাল্টে দিয়েছে। ‘৭৫ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির এমন পুনর্জাগরণ এবং সত্যকে যে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না- তাও প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। আর তাই শত প্রতিকূলতা ও সহিংসতা মোকাবেলা করে দেশের মানুষ সাহসের ওপর ভর দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার মিছিলে শামিল হয়েছে, ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াতের গণতন্ত্রবিরোধী সহিংস রাজনীতিকে। আর এখন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সত্য ইতিহাস যাতে আগামী প্রজন্ম যুগ যুগ ধরে লালন করতে পারে- বাকি মেয়াদে সেই পদক্ষেপই নিতে হবে ক্ষমতাসীন সরকারকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, টানা মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকার জোর গলায় বেশকিছু সাফল্যের কথা বলতেই পারে। যেমনÑ কৃষি, শিক্ষা, কূটনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতি। গত এক দশকে কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে বর্তমান সরকার। স্বাধীনতার ৪৯ বছরের মাথায় সর্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন, প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে বই বিতরণ, প্রাথমিক ও জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষার প্রবর্তন, দীর্ঘদিন পর শিল্পনীতি প্রণয়ন, সন্ত্রাস-ধর্মীয় জঙ্গীবাদ দমন, আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং কৃষিতে রীতিমতো বিপ্লবের সূচনা সরকারের বড় দাগের সাফল্যে হিসাবেই দেখছেন তাঁরা।
এছাড়া দেশী-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যার ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, প্রায় তিন কিলোমিটার পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। রাজধানীর যানজট কমাতে মেট্রোরেলের কাজও অধিকাংশ প্রায় সম্পন্ন। উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে চলছে মহাযজ্ঞ, রেলের ইঞ্জিন ও কোচগুলোও দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৩ শতাংশেরও বেশি। সেই দারিদ্র্যের হার বর্তমান সরকার মাত্র এক দশকেই ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশ। সেই ১৫ শতাংশ থেকে একভাগ হলেও দরিদ্র্রতা কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেশের প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের ওপরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। রেকর্ডসংখ্যক রিজার্ভ আর মাথাপিছু আয় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এসব ছাড়াও মাত্র ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাক হিসাব খোলা, কৃষি কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি ভর্তুকি প্রদান, বিনা সুদে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকের কৃষিঋণ প্রদান, দফায় দফায় সারের দাম কমানো, সেচপাম্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত প্রদান, সার-বীজ-ডিজেলসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের বাধা উপেক্ষা করে সারসহ কৃষি যন্ত্রপাতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকিসহ কৃষক কল্যাণে সরকারের নানা পদক্ষেপ কৃষি উৎপাদনে বিপ্লবের সূচনা নিঃশর্ত প্রশংসা অর্জন করেছে। এসব সাফল্যে জাতিকে আশান্বিত করেছে।
বাস্তবে এ দেশে সাধ ও সাধ্যে, চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা সহজ নয়। সরকারের গত ১১ বছরের পথও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, বরং ছিল কণ্টকাকীর্ণ। তবে কয়েকটি স্পর্শকাতর ইস্যু এবং বেশকিছু বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরকার তার মেয়াদের দ্বিতীয় বর্ষে পা রাখল। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরা, দেশের অর্থনীতিকে আরও স্বাবলম্বী করা, বিপর্যস্ত পুঁজিবাজারকে রক্ষা, রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলকে মোকাবেলা করা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণ করে জনগণের বিপুল জনসমর্থন বজায় রাখতে হবে বর্তমান সরকারকে।
তবে বর্তমান সরকার সফলভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে বাংলাদেশ তার হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সফলতা দেখাতে পেরেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকার এখন আগের চাইতে আরও বেশি সচেতন হয়েছে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পুরো পাঁচ বছরেই যেখানে ছিল দুর্নীতিই নিয়ামক, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। সেখানে বর্তমান সরকারের প্রথম বছরে ছোটখাটো কিছু অভিযোগ ছাড়া দালিলিক বা প্রামাণিক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতির অভিযোগ এখনও শোনা যায়নি। বর্তমান সরকার দক্ষভাবে দেশ পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদী বা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কালো তালিকা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এলডিসির অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে, বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম এক বছর কার্যপরিচালনায় সফলতার পাল্লা ভারি হলেও ব্যর্থতার পাল্লাও খুব একটা কম নয়। তারা বর্তমান সরকারের প্রথম বছরের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে চিহ্নিত করেছেÑ দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরতে না পারা। পেঁয়াজ সঙ্কট সরকারকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেয়। সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদেও এই দ্রব্যমূল্য নিয়েই দুশ্চিন্তায় সরকার। এছাড়া বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যাকা-সহ বেশ কিছু চরম বিতর্কিত কর্মকান্ডে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর একটি দুষ্টচক্র জড়িত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণœ করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়ে জড়িত দলমত নির্বিশেষ সবাইকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছেন। নিজ দলের যত বড় নেতাই হোন না কেন, কোন ধরনের অপকর্ম করলে কাউকেই ছাড় দিচ্ছেন না তিনি। এটিও সরকারের প্রথম বছরের আরেকটি বড় অর্জন বলেই সবাই একবাক্য স্বীকার করছেন।
অতীত সরকারগুলোর বছর পূর্তিতে ব্যর্থতা ও অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বিরোধী পক্ষ দেশব্যাপী ঝড় তুললেও এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। টানা তৃতীয় মেয়াদের বর্তমান সরকারের প্রথম বছরের হিসাব মেলাতে গিয়ে চরম বিরোধীপক্ষও বড় ধরনের ব্যর্থতার দালিলিক প্রমাণ হাজির করতে পারেনি দেশবাসীর সামনে। বরং অধিকাংশ মানুষের মূল্যায়নে বেরিয়ে এসেছে, বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই সঠিক পথে এগুচ্ছে। সরকার ও দলকে শক্তিশালী ও আলাদা করতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের কাউন্সিলে ৯ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীকে কোন পদে রাখেননি। দ্বিতীয় মেয়াদে বর্তমান মন্ত্রিসভায় কিছুটা রদবদল হতে পারে, সেখানেও বর্তমানে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কিছু মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবমিলিয়ে গত এক বছরে সরকারের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের পাল্লা অনেক ভারি। সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে জাতির পিতার নেতৃত্বে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।