ভজন শংকর আচার্য্য, কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ঐতিহ্যবাহী সালদানদীর প্রায় শত বছরের বালু মহাল বন্ধ করার প্রস্তাব করায় বিপাকে পড়েছে শত শত বালু শ্রমিক। এই বালূ মহাল বন্ধ হয়ে গেলে কাজের অভাবে রুটি রুজির পথ বন্ধ হয়ে যাবে শত শত বালু শ্রমিকের। যুগ যুগ ধরে এই বালু মহাল ইজারা দিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও হঠাৎ এই বালু মহাল ইজারা দেয়া বন্ধ করার প্রশাসনিক প্রস্তাবে হতবাক স্থানীয় জনসাধারন।
জানা যায়, সদ্য বিদায়ী সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো.জাহাংগীর হোসেনের নিকট গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সালদা নদীর ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বালু মহালের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি বিতর্কিত প্রতিবেদন দাখিল করেন ইউনিয়ন ভ’মি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম। এই বালু মহাল নিয়ে এলাকার কারো কোনো অভিযোগ না থাকা সত্বেও ওই প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ সরকার ও জনগনের স্বার্থ বিরোধী বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বালূ শ্রমিকদের অভিযোগ। বায়েক ইউনিয়নের ভ’মি সহকারী কর্মকর্তা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন বালু মহালটির আয়তন ৪০ একর। প্রতিবেদনে তিনি আরো উল্লেখ করেন নয়নপুর, কৈখলা, গৌরাঙ্গলা, শ্যামপুর, খাদলা, নিশ্চিন্তপুর ও পুটিয়া মৌজার উপর দিয়ে সালদা নদী ও বালু মহালটি প্রবাহমান। বালু মহালটি গৌরাঙ্গলা বালু মহাল হিসেবে পরিচিত। প্রকাশ্যে ইহা ঐতিহাসিক সালদানদী হিসেবেও পরিচিত। বালু মহালটিতে বৃষ্টির ফলে ভারত থেকে পানির ¯্রােতের সাথে বালু প্রবাহ এসে জমা হয়। তিনি নদীটির প্রশস্থ ৩০/৪০ ফুট দেখিয়ে নদীর উভয় পাশে বাড়িঘর ও জমিজমা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া বৃষ্টি হলে নদীর স্্েরাতের তোড়ে বাড়িঘর ও ফসলী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় বলেও উল্লেখ করেন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে এবং নদীর রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই ঐতিহাসিক নদীটি দিয়ে শুস্ক মৌসুমেও ¯্রােত প্রবাহমান থাকে। মূল নদী থেকে দুপাশে ২শ-৩শ ফুট দূরে নদীর উভয় পাশে বাড়িঘর ও জমিজমা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ইউনিয়ন ভুমি কর্মকর্তা। তবে উভয় পাশে তেমন কোনো বসতি বা বাড়িঘর নেই। যে কয়টি বাড়িঘর রয়েছে এরা অবৈধভাবে নদীর পাড়ে খাসভ’মিতে বসবাস করছে। নদীটির কোথাও কোনো ৩০/৪০ ফুট প্রসস্ত নয় বরং সর্বনি¤œ ৭০ ফুট থেকে ৩শ ফুট পর্যন্ত প্রসস্ত নদীর জলাধার রয়েছে। ১৯৫৪ সালে নদীর বালু মহালটি ইজারা হয়েছিলো, ১ লাখ ৫১ হাজার টাকায়। প্রতিবছর এর ইজারা মূল্য বেড়ে গিয়ে ১৪১৮ বাংলায় ৪০ লাখ টাকায় ২০২১ বাংলা সালে ৪৩ লাখ ৭১ হাজার টাকায়, ১৪২০ বাংলায় ৪০ লাখ ৬১ হাজার টাকা, ১৪২২ বাংলা সালে ৩৬ লাখ ৩০ হাজার ৬শত ২টাকা ইজারা হয়েছে। ১৪২৬ সালে ইজারা দিতে বিলম্ব হওয়ায় মাত্র ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায় আবুল খায়ের গংরা ইজারা পায়।
এ বিষয়ে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা মো.আশরাফুল আলমের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেন; সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাহাঙ্গীর হোসেন’র অধিন্যস্ত হিসেবে আমি চাকুরী করি। তাঁর তাৎক্ষনিক নির্দেশে ওই দিন আমি তাঁর কার্যালয়ে বসে এই রিপোর্টটি তৈরি করে দিতে বাধ্য হই। জানা যায়, প্রতিবেদনটি তিনি একই দিনে সহকারী কমিশনারের নিকট পেশ করলে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে সহকারী কমিশনার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট পেশ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী অফিসার অগ্রবর্তী দিয়ে প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসকের নিকট পাঠান। জেলা প্রশাসক কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, বালু মহালটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য ভ’মি মন্ত্রনালয়ে সুপারিশ পাঠানো হওয়ায় আগামী বৈশাখ মাসে বালু মহাল ইজারা দেয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হচ্ছে না। ফলে বালু শ্রমিক ও বালু ব্যবসায়ীদের মাঝে হতাশা নেমে এসেছে। এ বিষয়ে বায়েক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আল মামুন ভ’ইয়া জানান উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন কেন বালু মহালটি বন্ধ করতে চায় তা আমার বোধগম্য নয়। বিপুল পরিমান রাজস্ব ভ’মি মন্ত্রনালয় পেয়ে থাকেন। এখানে ইউনিয়ন পরিষদের কোনো বিষয় নেই। তিনি এ বিষয়টি আইনমন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়েছেন বলে জানান।
স্থানীয় ঠিকাদার সাদ্দাম হোসেন, মো.মানিক, মো.ফিরোজ সহ একাধিক প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার জানান; সালদার বালু অত্যন্ত উন্নতমানের হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। নদীর পাশ্ববর্তী গৌরাঙ্গলা গ্রামের আলমগীর হোসেন ও জাহাংগীর হোসেন জানান প্রতি বছর বালু উত্তোলন করা না হলে নদীর নাব্যতা হারিয়ে আশে পাশের জমিতে গিয়ে এই বালু জমা হবে। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়বে এলাকার ফসলী জমি। এমনিতেই অতি বৃষ্টিতে এবং পাহাড়ী ঢলের পানিতে সীমান্তবর্তী ইউনিয়নটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সালদা গ্যাস, তেল ও বালি নামক খনিজ সম্পদ রক্ষনাবেক্ষন এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। তারা আরো বলেন; নদী পাড়ে বসবাস করে এমন কেউ বালূ উত্তোলনের বিষয়ে আপত্তি করেননি। এদিকে বালু মহালের ইজারাদার ও নয়নপুর বাজার ব্যাবসায়ী কমিটির সভাপতি আবুল খায়ের বলেন; আমার ব্যবসায়ী পার্টনার চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা নুরুন্নবী আজমলের সাথে বালু মহাল নিয়ে মোবাইল ফোনে ওই সহকারী কমিশনার (ভূমি)’র বাক বিতন্ডা হয়। সেই থেকে তিনি এই বালু মহালটি বন্ধ করার জন্য নানা ধরনের সুযোগ খুঁজছিলেন।
এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট রাশেদুল কাওসার ভ’ইয়া জীবন এ প্রতিবেদকে জানান, বালু মহাল থেকে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব পায়। সরকার যাতে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় একটি মহল সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে দিয়ে এটি বন্ধ করার পাঁয়তারা করছে বলে জানা যায়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদ আলম বলেন; জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মৌখিক নির্দেশে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার ভুমির পেশকৃত প্রতিবেদনটি পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের বরাবর পাঠাই। এ প্রতিবেদকের অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন বালু মহালের কারনে স্থানীয়দের কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এমন কোনো প্রকার অভিযোগ আমি পাইনি।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার ভ’মি মো.জাহাঙ্গীর হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর অফিসে গিয়ে জানতে চাইলে অফিসের অন্যান্য লোকজন জানান তাকে কসবা থেকে জনস্বার্থে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে।