প্রশান্তি ডেক্স ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ধরন্তি হাওরে ধান কাটছেন স্থানীয় শ্রমিকরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরাঞ্চলে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। অন্যান্য বছর ধান কাটার মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন জেলা থেকে প্রচুর ধান কাটার শ্রমিক আসলেও এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে বহিরাগত শ্রমিকের সংখ্যা কম। তবে ভ্যানচালক, রিকশাচালক, স্কুলছাত্রসহ বিভিন্ন পেশার বেকার শ্রমিক ও অত্যাধুনিক ধান কাটা মেশিন ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই জেলার সদর উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের বার আউলিয়ার বিল, রামরাইল ইউনিয়নের সেন্দ, মাছিহাতা ইউনিয়ন, বাসুদেব ইউনিয়ন, উজানিসার, কোড্ডা, সুহিলপুর, মজলিশপুর, সরাইল উপজেলার ধরন্তি, শাহজাদাপুর, বুড্ডা, আকাশি বিল, শাপলা বিল, নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর, চাতলপাড়, ভলাকুট, গোয়ালনগর, বাকলঙ্গন, জেঠাগ্রাম, চৈয়ারকুড়ি, বিজয়নগর উপজেলার চর-ইসলামপুর, পাহাড়পুর, পত্তন, হরষপুরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। বহিরাগত শ্রমিকের সংখ্যা কম থাকলেও ধান কাটায় কোন সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপ-পরিচালক মো. রবিউল হক মজুমদার। তিনি জানান, বহিরাগত শ্রমিক কম থাকলেও স্থানীয় শ্রমিক থাকায় ধান কাটায় সমস্যা হচ্ছে না। এছাড়াও জেলায় ৪০টি ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ মেশিন দিয়েও ধান কাটা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা ধান কাটার ক্ষেত্রে কৃষকদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করছেন। সরেজমিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ধরন্তি হাওরে গিয়ে দেখা যায়, ধান কাটছেন বাবুর্চি হাসান, স্কুলছাত্র মামুন, হকার মহরম আলী ভূইয়া, রিকশাচালক ফজল মিয়াসহ অনেকে। ধান কাটার ফাঁকে ফাঁকে হাসান জানান, তিনি ঢাকায় একটি হোটেলে বাবুচির কাজ করেন। করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে হোটেল বন্ধ থাকায় তিনি গত একমাস ধরে নিজ বাড়ি সরাইলে রয়েছেন। বাড়িতে বেকার থাকায় সংসারের অভাব অনটনের কারণে তিনি বাধ্য হয়ে অন্যান্য লোকদের সাথে ধান কাটছেন। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা না থাকায় ধান কাটতে তার কষ্ট হচ্ছে। বেকার অবস্থায় ধান কেটে যে টাকা পাই তা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চালাই। স্কুলছাত্র মামুন জানান, সে উপজেলার জয়ধরকান্দি আলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে স্কুল বন্ধ রয়েছে। তাই বাবার সাথে সেও ধান কাটছে। হকার মো. মহরম আলী ভূইয়া বলেন, তিনি চট্টগ্রামে হকারের কাজ করেন। বর্তমানে কাজ না থাকায় বাধ্য হয়েই ধান কাটছেন। রিকশাচালক ফজল মিয়া জানান, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে রিকশা চালান, বর্তমানে বেকার থাকায় গ্রামে এসে ধান কাটছেন। প্রতিদিন ধান কাটলে জনপ্রতি চারশত টাকা ও দুই বেলা খাবার দিচ্ছেন জমির মালিক। নাসিরনগর উপজেলার দাঁতমন্ডল এলাকায় গিয়েও দেখা যায়, ধান কাটার হিড়িক পড়েছে। ধান কাটা শ্রমিক প্রাণতোষ দাস বলেন, তিনি পেশায় জেলে। এখনও হাওরে পানি আসেনি। যে কারণে মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ধান কেটে সংসারের খরচ চালাই। একই ধরনের কথা বললেন দাঁতমন্ডল গ্রামের আব্দুর রহমান। পেশায় তিনি ইজিবাইক চালক। বর্তমানে ইজিবাইক চালাতে না পেরে তিনিও ধান কাটছেন। তিনি বলেন, ধান কেটে প্রতিদিন চারশত টাকা পান। এছাড়া জমির মালিক দু’বেলা খাবারও দেয়। এদিকে ধরন্তি হাওরে জমির মালিক কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, আগে ধান কাটার মৌসুমে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ থেকে প্রচুর ধান কাটা শ্রমিক আমাদের হাওরগুলোতে আসতো। করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর আগের মতো প্রচুর শ্রমিক আসতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়েই এলাকার অন্যান্য পেশার কর্মহীন, বেকারদেরকে দিয়ে ধান কাটাচ্ছি। তিনি জানান, বাইরের পেশাদার ধান কাটার শ্রমিকদের চাইতে স্থানীয় শ্রমিকদের মজুরি একটু বেশি। একই কথা বলেন কৃষক মুমিন মিয়া, শহীদুল হক। তারা বলেন, এলাকার লোকজন যদি বাড়িতে না আসত তাহলে জমির ধান জমিতেই পরে থাকতো। তারা আসায় জমির ধানগুলো বাড়িতে আনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপ-পরিচালক মো. রবিউল হক মজুমদার বলেন, চলতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ লাখ ১১ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবাদ হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রা প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ পূরণ হয়েছে। একভাগ কম হয়েছে রবি মৌসুমে কিছু জমিতে সরিষা, ভুট্টা ও সূর্যমূখীর চাষ করার কারণে। চলতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অঞ্চলে বোরো ধানের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৪শ ৫৮ মেট্টিক টন। তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর বোরো মৌসুমে জেলায় প্রায় ১৬ হাজার ধান কাটার শ্রমিক ধাপে ধাপে আসতো। চলতি মৌসুমে করোনা ভাইরাসের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও ইতিমধ্যে ৬ হাজার ৭শত বহিরাগত ধান কাটার শ্রমিক জেলায় এসেছেন। তাদের সাথে আমাদের স্থানীয় কর্মহীন ভ্যানচালক, রিকশাচালক, টেম্পু চালক, বাসের হেলপার, হকারসহ বিভিন্ন অকৃষিজ পেশার শ্রমিকেরা ধান কাটায় এগিয়ে এসেছেন। পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে ৪০টি ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ মেশিন দিয়েও ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তা বন্দি করা হচ্ছে। তিনি জানান, বহিরাগত শ্রমিক যারা এসেছেন তারা সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ধান কাটছেন। বহিরাগত শ্রমিকদের এক জায়গায় রেখে ধান কাটার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যাতে তারা স্থানীয় শ্রমিকদের সাথে মিশতে না পারেন।সকল প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে কৃষকরা তাদের ধান গোলায় তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন বলেন, আগে যেমন বহিরাগত শ্রমিকরা ধান কাটার মৌসুমে এই জেলায় এসে ধান কাটতেন এ বছরও তারা কাজ করবেন। হয়তো সংখ্যায় কিছুটা কম হবে। আমরা সকল প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। আশা করি, ধান কাটা নিয়ে কোন সমস্যা হবে না।
Share on Facebook
Follow on Facebook
Add to Google+
Connect on Linked in
Subscribe by Email
Print This Post