প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর চাপানো হচ্ছে যে ২ সিদ্ধান্ত

প্রশান্তি ডেক্স ॥ এটা ঠিক যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আমাদের এক অভূতপূর্ব বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কিন্তু তাই বলে বিবেচনাবোধ বিস্মৃত হওয়ার অবকাশ নেই। দুর্ভাগ্যবশত দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া দুটি সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে অবিবেচনাপ্রসূতই মনে হচ্ছে।একদিকে অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে তাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে, অন্যদিকে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অযৌক্তিক অর্থ। আমরা মনে করি, এতে করে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়তে পারে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে সর্বাত্মক লড়াই দেশজুড়ে চলছে, তাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন লাখের বেশি শিক্ষকও নিশ্চয়ই যোগ দেবেন। বস্তুত ‘লকডাউন’ পরিস্থিতিতেও ব্যক্তিগত পরিসরে সবাই সাধ্যমতো দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন, আমরা দেখেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সামষ্টিক উদ্যোগেও হয়েছেন শামিল। তাদের বৈশাখী ভাতা থেকে একটি অংশ ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেয়া হয়েছে। এরপরও কথিত ‘স্থানীয় তহবিল’ গঠনের নামে সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা আদায়ের উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা কী? বিভাগীয় উপ-পরিচালকের ‘টেলিফোনিক নির্দেশ’ উল্লেখ করে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই এই অর্থ আদায় করা হচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বা পরিপত্র ছাড়া জেলা বা উপজেলা প্রশাসন যে কোনো পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারির কাছ থেকে এভাবে অর্থ আদায় করতে পারে? কোথাও কোথাও এক দিনের বেতন কেটে নেয়ার যে খবর পাওয়া গেছে, তা আরও অগ্রহণযোগ্য। রীতিমতো পিয়ন পাঠিয়ে শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ আদায় আমাদের কাছে চাঁদাবাজিরই নামান্তর। আমরা দেখতে চাই, অবিলম্বে এভাবে অর্থ আদায় বন্ধ করা হয়েছে। নিছক ফোনের সূত্র ধরে অর্থ আদায়ের নির্দেশনা যারা দিয়েছেন, তাদেরও জবাবদিহির বিকল্প নেই। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার জারি করা চিঠির পাঁচ নম্বর কলামে উল্লেখিত, ‘প্রয়োজনে সহায়তা’ করার নির্দেশ কীভাবে অর্থ প্রদানে রূপান্তরিত হলো, খতিয়ে দেখতে হবে সেটাও। কোনো কোনো উপজেলায় শিক্ষা কর্মকর্তা ছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তা মিলে যেভাবে অর্থ আদায়ের হার ও ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করেছেন, তা কোন আইনের বলে- আমরা জানতে চাই। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এভাবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের খামখেয়ালি চলতে পারে না। একজনের খামখেয়ালিপনা কীভাবে আরেকজনের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে, ঈশপের ‘বালক ও ভেক’ গল্পে আমরা দেখেছি। ভাইরাসকবলিত এই সময়ে পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর নূন্যতম ব্যবস্থা না করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব যেন তারই ‘আধুনিক’ সংস্করণ। দেশের এই দুঃসময়ে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের পরিস্থিতি নিশ্চয়ই জানতে পারেন। বস্তুত আমাদের দেশে খানা জরিপ কিংবা ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ বহুলাংশে এই শিক্ষকরাই সম্পন্ন করে থাকেন। কিন্তু তাদের পিপিই না দিয়ে এমন দায়িত্ব দেয়া জেনেশুনে বিপদে ঠেলে দেয়া ছাড়া কী হতে পারে? তাদের একজনও যদি করোনা আক্রান্ত হয়, সেই দায় কে নেবে? মনে রাখতে হবে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বড় অংশ নারী। লকডাউন পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে যাতায়াতও সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে ফোনে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে বৈকি; কিন্তু সেই নির্দেশনা আসতে হবে যথাযথ প্রক্রিয়ায়। করোনাকালে যখন দায়িত্ব পালনকারী বিভিন্ন পেশাজীবীর ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করার দাবি উঠছে; তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়তির ওপর ভরসা করে ঘর থেকে বের হতে পারেন না। করোনাকালে দায়িত্ব পালনকারী অন্যান্য পেশাজীবী যেখানে প্রণোদনা বা বীমা সুবিধা পাচ্ছেন; তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর বাড়তি চাঁদার দায় চাপবে কেন? ভুলে যাওয়া চলবে না যে, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাণও মূল্যবান, তাদেরও অধিকার রয়েছে নিজের প্রাপ্য অর্থ নিজের সিদ্ধান্তে ব্যয় করার। শিক্ষার্থীদের ত্রাণ নিশ্চিত করতে গিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি আর যাই হোক, দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হতে পারে না। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমরা সবাই নিশ্চয়ই সাধ্যমতো সক্রিয় থাকব একই সঙ্গে সাবধানতারও বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.