শাখওয়াত হোসেন খাঁন॥ আমি দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর – একদিন আমার কয়েকজন সহকর্মীকে বললাম- চলো আজ শহর দেখি। চার দেয়ালের ভিতর বন্দি জীবনের দীর্ঘদিন কাটানোর পর-নিজের শহরটি কেমন হয়েছে। নিজ চোখে না দেখলেই নয়।
সহকর্মীদের সাথে নিয়ে আমি নগরের অলি গলি হাঁটি । ক্ষুধা পেয়েছে খুব। বললাম – সামনের মোড়ে যদি কোনো রেস্তোরা থাকে- সেখানেই জলযোগ করতে চাই।
ওরা অবাক। বললাম, অবাক হওয়ার কিছুই নেই। ক্ষুধা লেগেছে খাবো। কয়েদখানায় বিভৎস খাবার খেয়েও যেহেতু মরিনি। সুতরাং এতো সহজে মরবোনা।
টেবিলে খেতে বসেছি। অল্পদূরে আরেকজন ভদ্রলোক বসে আছেন। বেশ বয়ষ্ক। হোটেলের ওয়েটারকে বললাম- উনাকে বলো- আমার টেবিলে বসে খেতে। আর আরেকটি চেয়ার আমার পাশে এনে রাখো।
ভদ্রলোক আসলেন। এসে আমার পাশের চেয়ারটায় বসলেন। খেতে খেতে আমরা গল্প করছি। কিন্তু পাশে বসা লোকটি ঠিক খেতে পারছেন না। ওনার হাত কাঁপছে। চামচ থেকে খাবার প্লেটে পড়ে যাচ্ছে। সহকর্মীদের একজন বললেন- আপনি মনে হয় অসুস্থ। লোকটি চুপচাপ রইলেন। কিছুই বললেন না। আমি নিজ হাতে উনাকে খাবার খাইয়ে দিলাম। ওয়েটারকে বললাম- উনার খাবার বিলটাও আমরা পরিশোধ করবো।
খাবার শেষে উনি বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু এবার দেখলাম- ভালো করে দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারছেন না। শরীরের কাঁপুনি বেড়েছে। আমি নিজ হাতে উনাকে ওঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম। সহকর্মীদের একজনকে বললাম- উনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে।
সহকর্মীদের আরেকজন বললেন এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে -উনি বাড়ী পৌঁছাতে পারবেন তো। আমি বললাম- উনি অসুস্থ না। আমি জেলের যে সেলে বন্দি ছিলাম- উনি ছিলেন সেই সেলের গার্ড। প্রচন্ড মার খেয়ে আমার তৃষ্ণা পেতো খুব। পিপাসায় কাতর আমি যতবার পানি পানি বলে আর্তনাদ করতাম- ততবার উনি আমার সমস্ত শরীরে প্রসাব করে দিতেন। তাই, আজকে আমি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর – সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ হওয়ার পর যখন উনাকে আমার টেবিলেই আমন্ত্রণ করেছি- সেদিনের কথাগুলো মনে করেই উনি এতো ভয় পেয়েছেন।
কিন্তু ক্ষমতাবান হয়েই ক্ষমতাহীন মানুষকে শাস্তি দেয়াতো আমার আদর্শের পরিপন্থী। এটাতো আমার জীবনের এথিকসের অংশ নয়। তাই, শাস্তি পাওয়ার পরিবর্তে উনি ভালোবাসা পেয়েছেন। আমার মুখে উনি প্রসাব করছেন। উনার মুখে আমি খাবার তোলে দিয়েছি। আমি আপনাদের যেমন প্রেসিডেন্ট। উনারও প্রেসিডেন্ট।
প্রতিটি নাগরিককে সম্মান জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব। মনে রেখো- শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার মানসিকতাই একটি তৈরী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে- আর সহনশীলতার মানসিকতা একটা ধ্বংস রাষ্ট্রকে তৈরী করে।
রোবেন আইল্যান্ড প্রিজন সহ একাধিক কারাগারে দীর্ঘ ২৭ বছর বন্দি থাকা কিংবদন্তীতূল্য এই প্রেসিডেন্ট ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এতক্ষণ বললাম তারই কথা। তিনি খোদার নীতি ও আদর্শকে ব্রতী করে জীবনকে এগিয়ে নিয়েছেন আর তাঁর জীবন দিয়ে গৌরবান্বিত্ব হয়েছে স্বয়ং খোদা তায়ালা। আসুন আমরাও সেই নেলসন ম্যান্ডেলার মত নীতি ও আদর্শের ইতিবাচকতায় পূর্ণ হয়।