বাআ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, এ দুটি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের মাঝে এসএসসি পরীক্ষার জন্য আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে বোর্ডের পরীক্ষার ভীতি দূর করা এবং মেধাবী ও দরিদ্রদের মাঝে বৃত্তির নিয়মানুযায়ী বৃত্তি প্রদানের সুবিধার্থে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা ২০০৯ সালে চালু করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম হঠাৎ এ দুটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে কিছু কিছু সমালোচনা শুরু হয়ে গেল এবং এই পরীক্ষা বন্ধ করারও দাবি উঠল। কিন্তু তাদের এই দাবি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৭ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্লাশ ফাইভে এবং ক্লাশ এইটে আগে থেকেই বৃত্তি দেয়া হতো। তাই বৃত্তি পাওয়ার জন্য উভয় ক্লাশ থেকেই কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে বেছে নিয়ে আলাদাভাবে ক্লাশ করানো হতো। কিন্তুু এই শিক্ষার্থীদের বাইরে যারা ছিল তারা অবহেলিতই থেকে যেত। বাদ পড়ে যাওয়া এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কিন্তু মেধাবী থাকতে পারে, যাদের মূল্যায়ন হত না।
শেখ হাসিনা বলেন, সে জন্য আমি চিন্তা করলাম, সবাই পরীক্ষা দেবে। সেখান থেকে যারা মেধাবী বা দরিদ্র, অসচ্ছল তাদের যে নিয়ম মতো বৃত্তি দেয়া হয় সেভাবে বৃত্তি দেয়া হবে। কচি বয়সেই একটি বোর্ডের সার্টিফিকেট পাওয়া অত্যন্ত সুখকর অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্কুলে ভর্তির ১০ বছর পর (এসএসসি) আগে শিক্ষার্থীরা একটা সার্টিফিকেট পেত। আর সেখানে ক্লাশ ফাইভেই তারা যদি একটি সার্টিফিকেট পেয়ে যায় তাহলে বিষয়টি যেমন ভালো লাগে, তেমনি তাদের সেল্ফ কনফিডেন্সও বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামান এবং প্রথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবুহেনা মোস্তফা কামাল বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক-২০১৬ বিতরণ করেন। ১৯ জন কর্মকর্তা, শিক্ষক, পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট, ইনষ্ট্রাকটার ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিগণ এ পুরস্কার লাভ করেন।
শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক হিসেবে যশোরের জেলা প্রশাসক ড. মো. হুমায়ুন কবীর, শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে সাঁথিয়া মডেল বিদ্যালয় সাঁথিয়া, পাবনার সহকারী শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম এবং শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষিকা হিসেবে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার দাসপাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আফরোজা ইয়াসমীন প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে পদক গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যেও পুরস্কার বিতরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি খুব আনন্দিত যখন দেখলাম ২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ৯৮ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং এবতেদায়ীতে ৯৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ পাশ করেছে। শতকরা ৯৮ ভাগ পাশ করা মানে প্রায় সকলেই পাশ করা। তিনি বলেন, আগে দেখতাম আমাদের এসএসসি পরীক্ষায় ৪০ ভাগ পাশ করেছে। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগতো আমাদের শিক্ষার্থীরা তো খুব মেধাবী। তারা ফেল করবে কেন ? একটু কষ্ট করলেই তো পরীক্ষায় পাশ করা যায়।
প্রধানমন্ত্রী সার্বিক পাশের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। ঝরেপড়া রোধে ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ঝরেপড়ার হার হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, দারিদ্রপীড়িত এলাকায় শিক্ষার্থীদের খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দিতে ‘স্কুল ফিডিং প্রকল্প’ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে মোট ৯৩টি উপজেলায় ৩০ লাখ ৫ হাজার ৪০৯ জন শিক্ষার্থীদের পুষ্টিমানসমৃদ্ধ বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ, অভিভাবক ও জনগণকে সম্পৃক্ত করে সারাদেশে ‘মিড-ডে মিল’ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি সরকারের এই উদ্যোগে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, স্থানীয় বিত্তবান এবং অভিভাবকদেরও সম্পৃক্ত হওয়ার আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যালয় বহির্ভূত, অনগ্রসর, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ঝরেপড়া শিশুদের শিক্ষার জন্য ‘সেকেন্ড চান্স এডুকেশন’ ও ‘আনন্দ স্কুল’ চালু রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলায় ইতোমধ্যে ১৯টি আবাসিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জাতির পিতা বলতেন, “সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই”। আপনারা হচ্ছেন সেই সোনার মানুষ গড়ার কারিগর। আপনারাই পারেন প্রতিটি শিশুকে মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশপ্রেমিক ও আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে।
শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও মান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, শিক্ষকদের জন্য ৬০টি পিটিআইতে ১৮ মাস মেয়াদি ডিপিএড (ডিপ্লোমা-ইন-প্রাইমারী এডুকেশন) কোর্স চালু করা হয়েছে। পিটিআইবিহীন ১১টি জেলায় নতুন পিটিআই স্থাপন করা হয়েছে। ৫৫টি পিটিআইতে অত্যাধুনিক আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীতকরণসহ সহকারি শিক্ষকদের বেতনস্কেল আপগ্রেড করা হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে মেয়েদের জন্য ৬০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও এবদেতাদায়ী পরীক্ষায় ভাল ফল অর্জনকারী এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে দেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও সংগ্রামী জীবনের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জনে আগ্রহী হওয়ার আহবান জানান। তাঁর সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে চায় বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
‘আমি বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্ম বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধারণ করে বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শিক্ষক ও অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিতে হবে। আমরা ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং ২০১০ সাল থেকে মেয়েদের জন্য বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করছি। বাংলাদেশের মেয়েরা এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ বয়স ভিত্তিক মেয়েদের দক্ষিণ এশিয়া ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘স্টুডেন্টস কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ’ করা হয়েছে।
সুনাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলায় তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ধারণা প্রদানের জন্য ‘সুস্বাস্থ্যে-সুশিক্ষা’ বিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক চর্চা, চারু ও কারুকলা চর্চা বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হুইল চেয়ার, হেয়ারিং এইড, ক্র্যাচসহ অন্যান্য সরঞ্জাম প্রদান করা হচ্ছে।
শিক্ষার প্রসারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রসংগে প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, তাঁর সরকার একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গত আট বছরে বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১ হাজার ৫০০টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৭৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ৪০ বছর পর ২০১৩ সালে আমরা ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে ১ লাখ ১১ হাজার ৪৩ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮ হাজার ৯২৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের মধ্যে আরও ৫০ হাজার বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হবে। ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে ৪৬ হাজার শিক্ষককে ‘আইসিটি ইন এডুকেশন’ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় নিজ নিজ এলাকার স্কুলগুলোতে অথবা নিজেদের লেখাপড়া করা বিদ্যালয়কেই আধুনিক ডিজিটাল কনটেন্ট ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুমসমৃদ্ধ করে গড়ে তোলায় সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ এবং বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘কতই বা টাকা লাগে একটা কম্পিউটার বা একটা প্রজেক্টর নিজে যে স্কুলে পড়েছেন তার জন্য কিনে দিতে।… অনেকে এত বড়লোক আছেন যারা টাকা খরচ করবেন কোথায় তারও জায়গা অনেক সময় খুঁজে পান না।’
‘আমি সকলকেই আহবান জানাবো এই কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। দেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখা এবং শিক্ষাখাতের উন্নয়নে সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন- আমরা দেশ থেকে চিরতরে নিরক্ষরতাকে দূর করে সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত, জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলি। পরে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।