প্রশান্তি ডেক্স ॥ রোনার টিকা আসুক বা না আসুক ভাইরাসটি বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই বিদায় নেয়ার পথে আছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানালেও দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনা মহামারির সমাধান অন্যান্য সাধারণ মৌসুমি ভাইরাসের মতো এত সহজে হচ্ছে না। তারা সর্তক করে দিয়ে বলছেন, নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সামান্য কমে আসলেও এতে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তা, মানুষের চলাচলের ওপর হস্তক্ষেপ না করা এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সামনের শীতে ভাইরাসটি দ্বিতীয় ধাপে ও ভয়াবহ আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
মারাত্মক এ ভাইরাস থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে সরকারকে সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে সচেষ্ট থাকার পাশাপাশি কার্যকর করোনার টিকা আনার ব্যাপারে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
গত শনিবার (১৫ আগস্ট) এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন করোনার টিকা আসুক বা না আসুক করোনা এখন দেশ থেকে বিদায় নেয়ার পথে।
দেশ থেকে ধীরে ধীরে করোনার প্রকোপ কমে যাচ্ছে, মৃত্যুর হারও কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয়, ভ্যাকসিন আসতে দেরি হলেও কোভিড-১৯ বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে আরও কিছুদিন সময় লাগতে পারে। করোনা প্রতিরোধে আমাদের কোনো ভ্যাকসিন লাগবে কি না তা এখনও বলা যাচ্ছে না।’
যোগাযোগ করা হলে, দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘দেশ থেকে আপনা আপনি করোনার চলে যাওয়া নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর করা মন্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোন প্রসঙ্গে এবং কীভাবে তা বলেছেন আমি জানি না। আমি এও জানি না তিনি কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছেন কি না। মানুষ এখন করোনা নিয়ে খুব কমই ভাবে এবং কোনো ধরনের ভয়-ভীতি ছাড়াই সর্বত্র চলাফেরা করছে। আমার ধারণা, ভাইরাসটির নির্মূলের বিষয়ে তিনি এ জন্য এতটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন।’
ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘মন্ত্রী হয়ত হার্ড ইউমিনিটির বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। তবে তার জন্য জনগণের একটি বড় অংশকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হবে যা খুব সহজ কোনো বিষয় নয়, যেহেতু আমাদের পরীক্ষা করার সক্ষমতা খুবই কম। এখন পর্যন্ত ঠিক কী পরিমাণে লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সে সম্পর্কেও আমাদের কাছে সঠিক তথ্য নেই। আমি মনে করি না যে ভাইরাসটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে আমরা হার্ড ইউমিনিটির কথা ভাবতে পারি।’
ডা. আবদুল্লাহ বিশ্বাস করেন, ‘হার্ড ইউমিনিটির কথা চিন্তা না করে আমাদের দেশের জনসংখ্যার আকার এবং ঘনত্ব বিবেচনা করে ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে কার্যকর টিকা নিয়ে আসার বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়া উচিত।’
আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদুল আজহার আগে বিপুলসংখ্যক লোক দেশের বিভিন্ন করোনার হটস্পট ছেড়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। এতে করে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। আমাদের করোনা পরিস্থিতি এবং সংক্রমণের প্রবণতা কঠিনভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কার্যকর টিকা পাচ্ছি এবং তা আমাদের সাশ্রয়ী ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসছে, তত দিন পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।’
অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম উল্লেখ করে ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘এতে আত্মতৃপ্ত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই, কেউ বলতে পারছে না ভাইরাসটি আসলে কবে নির্মূল হবে। অন্য অনেক ভাইরাসের মতো করোনাও দীর্ঘদিন ধরে থাকতে পারে। শীতে যা আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে। তাই, আমি মনে করি করোনার মতো মহামারি মোকাবিলায় টিকাই একমাত্র ভরসা হতে পারে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, মন্ত্রী এক ‘বিভ্রান্তিকর’ মন্তব্য করেছেন যা মানুষকে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি না মানার বিষয়ে উৎসাহিত করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না কোনো টিকা ছাড়াই কোভিড-১৯ মহামারি বিদায় নিতে পারে। মন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্যের পিছনে কোনো যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের এটা মানতে হবে যে করোনা একটি মহামারি, একটি অন্যান্য মৌসুমি ভাইরাসের মতো না।’
এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট দেশে বা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া পানিবাহিত রোগ হেপাটাইটিস-ই এর মতো সাধারণ মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসতেই অনেক সময় লেগেছে। আর করোনার মতো ভয়ানক মহামারি যা ইতোমধ্যে বিশ্বের সবকটি মহাদেশের প্রায় ২০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তা থেকে আপনা আপনি আমরা কীভাবে মুক্তি পাওয়ার কথা ভাবতে পারি?’
বে-নজির বলেন, চীনই একমাত্র দেশ যারা এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শতভাগ সফল বলে মনে হচ্ছে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১৫০টি দেশ ৪০ থেকে ৯০ ভাগ সাফল্য দেখিয়েছে। তবে সংক্রমণ হার কমাতে ব্যর্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
তিনি বলেন, যেসব দেশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সাফল্য দেখিয়েছে তারা সামাজিক দূরত্ব, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউনের মতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা কঠোরভাবে মেনে চলেছে। ‘এর মধ্যে আমরা কোনো নিয়মই সঠিকভাবে মানতে পারিনি। করোনা নির্মূলে টিকা কেনার প্রচেষ্টার পাশাপাশি আমাদের এখন এ স্বাস্থ্যবিধিগুলো কঠোরভাবে পুনরায় মেনে চলতে হবে। অন্যথায়, কোনো কিছুই আমাদের দীর্ঘ সংক্রমণ চক্র থেকে বাঁচাতে পারবে না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘দেশে প্রথম ধাপে ভাইরাসটির সংক্রমণ কিছুটা ধীরে ধীরে বেড়েছে, তবে শীতকালে দ্বিতীয় ধাপে মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাই আমাদের এখন পরিকল্পনা করা উচিত যাতে শীতকালে আমরা ভাইরাসটিকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারি।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, ‘যেসব দেশে এখনও করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যু উভয়ই খুব বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তাই আমাদের এটা মনে করার উচিত হবে না যে ভাইরাসটি কোনো টিকা এবং সঠিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এমনি এমনি দেশ থেকে নির্মূল হয়ে যাবে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের সঠিক কৌশল এবং পরিকল্পনা দরকার।’
অধিক জনসংখ্যা এবং স্বাস্থ্যসেবার দুর্বল ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস নির্মূলের জন্য বাংলাদেশের জন্য দুটি বিকল্প রয়েছে- একটি হলো টিকা এবং অন্যটি ডব্লিউএইচও’র নির্দেশনা। বাস্তবিক অর্থে টিকাই মারাত্মক এ মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র বিকল্প। একটি কার্যকর টিকার জন্য আমাদের যা করা দরকার তা যত দ্রুত সম্ভব করা উচিত।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোসতাক হোসেন বলেন, জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। মন্ত্রীর বক্তব্যের অবশ্যই গুরুত্ব আছে। তবে মন্ত্রীর যে বক্তব্য নিয়ে এত সমালোচনা হচ্ছে- আমি মনে করি, এটি মন্ত্রীর অফিসিয়াল কোনো বক্তব্য নয়।