প্রশান্তি ডেক্স ॥ নেতাকর্মীদের জন্য প্রয়োজনে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে প্রস্তুত আছেন বলে মন্তব্য করেছেন ফরিদপুর-৪ আসনের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।
ভাঙ্গা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ জামে মসজিদের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন শেষে গত বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) বিকালে সেখানে উপস্থিত হাজারো নেতাকর্মীর উদ্দেশে তিনি একথা বলেন। এর আগে নিক্সন চৌধুরীর আসার খবর শুনে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই হাজারো নেতাকর্মী ঈদগাহ মাঠে ভিড় জমান।
নিক্সন চৌধুরী বলেন, ‘আমার রাজনীতি জনগণের জন্য, জনগণের উন্নয়ন ও মূল্যায়ন আমার মূল লক্ষ্য। আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ হতে আচরণ বিধি ভঙ্গের মামলা খেয়েছি; এর জন্য আমার কোনো ভয় নেই। আমি আমার নেতাকর্মীর জন্য প্রয়োজনে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে সবসময় প্রস্তুত আছি।’
ফরিদপুর-৪ আসনের জনগণ তাকে ভোট দিয়ে দুইবার এমপি নির্বাচিত করেছেন উল্লেখ করে নিক্সন চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়ন দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে যেমন রোল মডেল হিসাবে পরিচিতি করিয়েছেন; ঠিক তেমনি তার অনুপ্রেরণায় ফরিদপুর-৪ আসনে প্রতিটি রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ব্রিজ, কালভাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবনসহ নানা উন্নয়ন করে বাংলাদেশের মধ্যে ফরিদপুর-৪ আসনকে রোল মডেল হিসাবে রূপ দিয়েছি। সবই সম্ভব হয়েছে জনগণের জন্য আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য।’
এসময় ফরিদপুর-৪ আসনের এই সাংসদ ভাঙ্গা উপজেলার জণগণের ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে নানা অভিযোগ আর ভোগান্তি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের দিকে ইঙ্গিত করে নিক্সন চৌধুরী বলেন, ‘পানামা কেলেঙ্কারিসহ তার নমিনেশন বাণিজ্যের কারণে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার যে নীল নকশা তিনি করছেন তারও বিচার করতে হবে।’
এসময় জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান শাহিনুর শাহিন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম হাবিবুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা ইসাহাক মোল্লা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফাইজুর রহমান, তুজারপুর ইউপি চেয়ারম্যান বাবু পরিমল দাস, হামেরদী ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শামচুল আলম রাসেল, ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সফিকুর রহমান, সরকারি কেএম কলেজের সাবেক জিএস লাবলু মুন্সিসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের মামলায় ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনকে হাই কোর্ট থেকে দেওয়া আগাম জামিনে হস্তক্ষেপ করেনি আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত।
জামিন আটকাতে রাষ্ট্রপক্ষ যে আবেদন করেছিল, চেম্বার বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান বৃহস্পতিবার তাতে ‘নো অর্ডার’ দিয়েছেন। ফলে এ সংসদ সদস্যকে দেওয়া হাই কোর্টের জামিন বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী।
জামিনে হস্তক্ষেপ না করলেও বিচারক প্রশ্নে রেখেছেন, একজন সংসদ সদস্য হয়ে নিক্সন চৌধুরী ‘এসব’ কথা (জেলা প্রশাসক অতুল সরকার ও ভাঙ্গার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোনে যা বলেছেন) বলতে পারেন কিনা।
এরপর বিচারক বলেন, “যেহেতু এটি একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের আগাম জামিন, তাই এতে হস্তক্ষেপ করছি না, নো অর্ডার।”
বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারোয়ার কাজলের বেঞ্চ গত মঙ্গলবার শর্তসাপেক্ষে আট সপ্তাহের জামিন দেয় নিক্সন চৌধুরীকে।
শর্ত হল: মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে সাক্ষীদের প্রভাবিত করা যাবে না; স্থানীয় প্রশাসনকে কোনো ভয়ভীতি দেখানো যাবে না এবং তদন্ত কর্মকর্তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে হবে।
হাই কোর্টে জামিন শুনানিতে নিক্সন চৌধুরীর আইনজীবী শাহদীন মালিকের যুক্তি ছিল, আইনগতভাবে কারো টেলিফোন কনভারসেশন রেকর্ড করার ক্ষমতা কারো নাই। ফলে তা রেকর্ডিং সাক্ষ্য হিসেবে আসতে পারে না।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ এর ৭১(ক) ধারা অনুযায়ী কারো কল রেকর্ড করতে হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বাক্ষরে অনুমোদন লাগে। অথচ মামলার এজাহারে এরকম একটি কল রেকর্ডিংয়ের কথা বলা হয়েছে।
হাই কোর্টের একটি রায় থেকে উদ্ধৃত করে শাহদীন মালিক বলেছিলেন, কারো অজান্তে কল রেকর্ড করা বেআইনি, ফাঁস করা বেআইনি। আর সংবিধানের ৪৩ ধারায় যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে ‘মিছিল, মিটিং, শোডাউন করে’ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এজাহারে নিক্সন চৌধুরী ছাড়া আর কারো নাম বা অজ্ঞাত কারো কথা উল্লেখ নেই। ফলে একজনের পক্ষে মিছিল, মিটিং, শোডাউন করে আচরণবিধি লঙ্ঘন কারা কীভাবে সম্ভব- সেই প্রশ্ন তোলেন এই আইনজীবী।
ফরিদপুরের জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা নওয়াবুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার চরভদ্রাসন থানায় সাংসদ নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়ে, গত ১০ অক্টোবর চরভদ্রাসন উপজেলার উপ নির্বাচনে কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করায় জেলা প্রশাসক অতুল সরকারকে ফোন করে কৈফিয়ত দাবি করেন সাংসদ নিক্সন। তার সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হলে মহাসড়ক অবরোধ করার ‘হুমকি’ দেন এবং ‘অশোভন আচরণ’ করেন।
একইসাথে নির্বাচনের দিন একটি ভোট কেন্দ্রের বুথের সামনে জাল ভোট দেওয়া ও ধূমপান করার সময় একজন পোলিং এজেন্টকে আটকের পর চরভদ্রাসনের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভাঙ্গার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সাংসদ ‘অত্যন্ত অশালীন ভাষায় গালিগালাজ, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং হুমকি’ দেন বলে অভিযোগ করা হয় মামলায়।
একজন সংসদ সদস্য হয়েও নির্বাচনী এলাকায় উপস্থিত থেকে নির্বাচনের প্রচারে অংশগ্রহণ করে এবং দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের ‘গালিগালাজ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে’ নিক্সন চৌধুরী নির্বাচনী বিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
ভোটের দিন সকালে সাংসদ নিক্সন চরভদ্রাসনের ইউএনওকে ফোন করে হুমকি-ধমকি দেন এবং অপর একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে গালিগালাজ করে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন বলে অভিযোগ ওঠে। তার ওই টেলিফোন আলাপের অডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা।
পরে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন সাংসদ মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন। তার দাবি, হুমকি দেওয়ার যে অডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, তা ‘সুপার এডিটেড’।