নাচে-গানে মাতলেন গায়ে হলুদের অতিথিরা, মুহূর্তেই রক্তের স্রোত

প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেবীদ্বারে বিয়ে বাড়ির হলুদ অনুষ্ঠানে গান বাজিয়ে নাচানাচির আয়োজনকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে ২ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ২০ জন। মারাত্মক আহত ৩ জনকে ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে গত বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টায় উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের জীবনপুর গ্রামের ইনসাফ মার্কেটে। ঘটনার পর রাতেই পুলিশ আব্দুল্লাহপুর গ্রামের বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত সাদেক মিয়ার পুত্র ও কনের পিতা মো. জাকির হোসেন (৪৫) এবং প্রতিবেশী জীবনপুর গ্রামের ইব্রাহীম মিয়ার পুত্র বাছির মিয়াকে (২৫) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে।
নিহত দু’জন হলেন- মুরাদনগর উপজেলার গুঞ্জর গ্রামের আবু হানিফের পুত্র কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র রাহিম হাসান (১৭) এবং দেবীদ্বার উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের পুত্র সাইফুল ইসলাম (২০)। সংবাদ পেয়ে দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুর রহমান একদল পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে রাহিম হাসানের মরদেহ ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সাইফুলের মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, গত বুধবার সন্ধ্যার পর সুবিল ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সাদিক মিয়ার বাড়িতে প্রবাসী মো. জাকির হোসেনের কন্যার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান চলছিল। ওই অনুষ্ঠানকে ঘিরে বাড়ির শিশু-কিশোররা ডেকসেট বাজিয়ে নাচ-গান করছিল। এ সময় পার্শ্ববর্তী মুরাদনগর উপজেলার ১৪ নম্বর পূর্ব নবীপুর ইউনিয়নের গুঞ্জর গ্রামের ৫-৬ জন কিশোর-তরুণ এসে নাচে অংশ নেন। সেখানে গুঞ্জর গ্রাম থেকে আসা ছেলেদের বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে তাদের কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। পরে স্থানীয় সাবেক ইউপি মেম্বার জুলহাস মিয়া এসে ডেকসেট বন্ধ ও নাচগান না করতে বলে চলে যান।
পরে গুঞ্জর গ্রামের ছেলেরা তাদের এলাকায় খবর দিলে আরো কিছু কিশোর-তরুণ ছুটে আসেন। এ সংবাদ ছড়ালে স্থানীয় ছেলেরাও ঐক্যবদ্ধ হয়। বিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ৫ শত গজ দূরে ইনসাফ মার্কেটে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে পুরো এলাকাই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এসময় ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান গুঞ্জর গ্রামের আবু হানিফের পুত্র কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র রাহিম হাসান (১৭)। অপরদিকে, বুকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত হন আব্দুল্লাহপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের পুত্র সাইফুল ইসলাম (২০)। চাকুর আঘাতে গুঞ্জর গ্রামের মো. জয়দল হোসেন মোল্লার পুত্র মো. আক্তার হোসেনের (১৬) নাড়ি-ভূড়ি বেরিয়ে যায়। বুকে ও পেটে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন একই গ্রামের মজিবুর রহমানের পুত্র মো. মামুনুর রশিদ (২০)। আব্দুস সালামের পুত্র মো. সজিবের (১৩) কণ্ঠনালী কেটে যায়।

আহতদের উদ্ধার করে দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মো. আলমগীর হোসেন গুরুতর আহত সাইফুলকে মৃত ঘোষণা করেন। অপর ৩ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখান থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মারাত্মক আহত ৩ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তাদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আহত ৩ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
প্রবাসী মো. জাকির হোসেনের স্ত্রী সেলিনা আক্তার জানান, তার স্বামী মো. জাকির হোসেন ওমান প্রবাসী। সেখানে বড় ছেলে নাজমুল হাসানকে (২৫) নিয়ে তিনি থাকেন। ছোট ছেলে রহমান ও একমাত্র মেয়ে নাজমাকে (১৯) নিয়ে তিনি বাড়িতেই থাকেন। ছোট ছেলে রহমান স্থানীয় আব্দুল্লাহপুর হাজী আমির উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ওমান প্রবাসী মো. হোসাইন নামে এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেন বাবা। হোসাইন একই উপজেলার প্রতিবেশী বুড়িরপাড় গ্রামের আব্দুল মতিন মিয়ার ছেলে।
তিনি বলেন, বর ওমানে থাকা অবস্থায় গত বছরের ২৪ জুলাই টেলিফোনে আমার মেয়ের সাথে বিয়ে সম্পন্ন করে। মেয়েকে তুলে দিতে আমার স্বামী মার্চ মাসের ৫ তারিখ দেশে আসেন। মেয়ের জামাইও গত সপ্তাহে দেশে আসে। গত (বুধবার) ছিল আমার মেয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। গত বৃহস্পতিবার বরযাত্রী আসার কথা ছিল কনে নিয়ে যেতে। কিন্তু গতরাতের ঘটনায় থমকে গেল বিয়ের আনন্দ, নিমেষেই সব কিছু মাটি হয়ে গেল। পুলিশ এসে সব আয়োজন বন্ধ করে দিয়ে আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়।
গুঞ্জর গ্রামের নিহত রাহিমের পিতা অসুস্থ আবু হানিফ বুক চাপড়ে বলেন, আমার ছেলেকে বিয়ে বাড়ির আনন্দ উৎসবে নাচতে নিয়ে গিয়েছিল তার বন্ধু সাইফুল। সাইফুলও মারা গেল, সাথে আমার ছেলেও মরল। কেন এমনটা হলো, এর বিচার চাই। নিহত সাইফুলের মা আউলিয়া আক্তার সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে শোকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন আর বলছেন, ধার-দেনা করে সৌদি আরব যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। ৫ দিন পর পাসপোর্ট হাতে এলে যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক করার কথা, এসব বলে আহাজারী করছেন তিনি।
স্থানীয় আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আলী হোসেন জানান, আমাদের এ এলাকার মেয়েরা গুঞ্জরের বখাটে ছেলেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। ওরা আমাদের এলাকার মেয়েদের সাথে প্রায়ই ইভটিজিং করতো। গত কিছুদিন পূর্বে গুঞ্জরের ছেলেদের বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের দায়ে একটি শালিসও হয়েছিল। তার রেশ শেষ না হতেই আবারো একটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে গেল।
দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুর রহমান বলেন, গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে ডেকসেট বাজিয়ে নাচ গানের সময় ইভটিজিংয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে বাকবিতন্ডা ও হাতাহাতি হয়। পরে বিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ৫শ গজ দূরে ইনসাফ মার্কেটে গিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসেছি। তদন্ত চলছে, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কুমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত তিনজনেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহরিয়ার আলম মিয়াজী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, বিয়ে বাড়ির একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.