রাজিউর রহমান ॥ পাঁচ থেকে ছয় বছর আগেও বিরাজোত গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িঘর ছিল শণের তৈরি অথবা কাঁচা। এখন সেই গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই উঠছে পাকা ঘর। চক চক করে জানালার থাই গ্লাস। পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়নের বিরাজোত গ্রামের এই বদল হয়েছে চা–গাছের চারা বিক্রি করে। পঞ্চগড় জেলায় চায়ের চারার কথা উঠলেই সবার মুখে চলে আসে এই বিরাজোত গ্রামের নাম। আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে চায়ের নার্সারি গ্রাম হিসেবে। প্রায় প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছেন চায়ের চারা কিনতে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, বিরাজোত গ্রামে ১২০ থেকে ১৩০টি পরিবারের বসবাস। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১০০টি পরিবারের মানুষই চায়ের নার্সারির কাজে যুক্ত। এ গ্রামের মানুষের দেখাদেখি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও বাড়ছে চায়ের নার্সারি, বাড়ছে চা–চাষি। পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উত্তরে বিরাজোত গ্রাম। চারদিকে সবুজের সমারোহে গ্রামটি বেশ মনোরম। গ্রামের ভেতর ঢুকলেই চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে খড়ের তৈরি শেড। এই শেডের নিচেই করা হয়েছে চায়ের নার্সারি। গ্রামের প্রায় বেশির ভাগ আবাদি জমিতেই এখন চায়ের নার্সারি। বিভিন্ন নার্সারিতে মালিকেরা শ্রমিকদের নিয়ে করছেন পরিচর্যার কাজ। অনেকেই আবার বাইরে থেকে চারা কিনতে আসা ক্রেতাদের কাছে চারা বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
নার্সারিমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেউ নিজস্ব জমিতে আবার কেউ কেউ অন্যের জমি ভাড়া (চুক্তি) নিয়ে গড়ে তুলেছেন নার্সারি। অনেকেই আবার চা বোর্ড থেকে নার্সারি করার জন্য নিবন্ধনও নিয়েছেন। প্রতিটি নার্সারিতে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ পর্যন্ত চায়ের চারা তৈরি করা হয়েছে। বিরাজোত গ্রামের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী ডাঙ্গাপাড়া, কামারপাড়া, পতিপাড়া, বন্দিপাড়া, সবাহেবীজোত গ্রামেও শুরু হয়েছে এই নার্সারি ব্যবসা। প্রতিটি চারা বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা দরে। বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলায় এখন পর্যন্ত মোট ২১টি নার্সারি নিবন্ধন নিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে বিরাজোত গ্রামেই সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া নিবন্ধনের বাইরে শতাধিক নার্সারি আছে।
মার্চ থেকে নভেম্বর পযন্ত চায়ের মৌসুম চলাকালে এই নার্সারিও করা যায় বলে জানায় চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। নার্সারিমালিকেরা জানান, প্রতি কাঠা জমিতে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত চায়ের চারা উৎপাদন করা যায়। একটি মৌসুমের চারা উৎপাদনের জন্য প্রতি কাঠা জমি সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। প্রথমে হাল চাষ করে জমি প্রস্তুতের পর মাটিগুলোকে ঝরঝরে করে ৪ ইঞ্চি বাই ৫ ইঞ্চি আকারের পলিব্যাগ কিনে তার ভেতর মাটি ভরতে হয়। পরে খড় ও বাঁশের তৈরি শেডে মাটিভর্তি পলিব্যাগগুলো সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়। পরে সেগুলোতে চা–বাগান থেকে সংগ্রহ করা চায়ের কাটিং (চারা তৈরির কান্ডসহ পুরোনো পাতা) বসানো হয়।
এরপর বেশ কিছুদিন পরিচর্যায় ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে চায়ের চারা। এই চায়ের চারাগুলো রোপণ কিংবা বিক্রি উপযোগী হতে সময় লাগে ৯ থেকে ১০ মাস। একেকটি চারা বিক্রির উপযোগী করতে নার্সারিমালিকদের দুই থেকে আড়াই টাকা পযন্ত খরচ হয়। বিরাজোত গ্রামের নার্সারিমালিক মো. জমিরুল ইসলাম বলেন, চলতি মৌসুমে তিনি ৭০ হাজার চায়ের চারা উৎপাদন করেছেন। ইতিমধ্যে ৬ থেকে ৮ টাকা দরে প্রায় ৬৫ হাজার চারা বিক্রি করেছেন। এখান থেকে শুধু পঞ্চগড় নয়, সিলেট থেকেও চা–চাষিরা চায়ের চারা কিনতে আসেন। বেশ কিছুদিন ধরে চায়ের নার্সারি করে গ্রামের মানুষের জীবনমান পাল্টে গেছে। এই নার্সারি করে এই গ্রামের মোটামুটি সবাই স্বাবলম্বী।
নার্সারিমালিক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি এবার মোট এক লাখ চায়ের চারা উৎপাদন করেছেন। এতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছেন, এই চারা পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ চায়ের চারা উৎপাদন করেন। এখন নতুন করে অনেকে চায়ের বাগানও করছেন। চায়ের সঙ্গে থেকে এই এলাকার প্রত্যেক মানুষের আর্থিক পরিবর্তন হয়েছে। মোটামুটি সবাই এখন পাকা বাড়িঘর করছেন।’
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, পঞ্চগড় জেলায় যেসব এলাকায় চায়ের নার্সারি হয়, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নার্সারির সংখ্যা বিরাজোত গ্রামে। চায়ের নার্সারি করে মানুষ বেশ উপকৃত হচ্ছেন। ওই গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে তাঁরা বেশ কয়েকবার কর্মশালা করেছেন। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন মানুষ এই ব্যবসায় ঝুঁকছেন। তবে তাঁরা বিটি সিরিজের (বাংলাদেশি প্রযুক্তির) চায়ের চারা করার জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছেন এবং কাটিং সরবরাহ করছেন।