সাদি ইসলাম জয়॥ বঙ্গবন্ধু। একটি মহাকাব্যের নাম। মহাকাব্য বাঙালি জাতির জন্মের। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের ক্যারিশমায় বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। একইভাবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত দক্ষতায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়ন ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আদি স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন শান্তি ও ন্যায়ের প্রতীক। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ একটি বিশ্বব্যবস্থার। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পররাষ্ট্রনীতির এই দর্শন প্রতিফলিত হয় ১৯৭২ সালের সংবিধানে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত তত্পর। সদ্য স্বাধীন দেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ ছিল একটি প্রধান সমস্যা। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর কর্মতত্পরতায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ সুগম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সোয়া দুই বছরের মধ্যে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের ১২১টি দেশের পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন করে।
আমাদের এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে বঙ্গবন্ধু সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্থাপন করেছিলেন একটি অর্থবহ সম্পর্ক। বিরূপ পরিস্থিতিতেও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু জাপানের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক। ১৯৭৩ সাল জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি তাত্পর্যপূর্ণ বছর। এ বছর বঙ্গবন্ধু জাপান সফর করেন। উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলে জাপানের বহু প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় বেশকিছু চুক্তি।
বঙ্গবন্ধুর সময়কালে তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধিদের মধ্যে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুগোসøাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন, সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেঙ্ঘর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো প্রমুখ।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। তাঁদের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রো, মালয়েশিয়ার রাজা আবদুল হালিম, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন অন্যতম।
স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যে কমনওয়েলথ ও জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রম-লীর দলে যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ। রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতায় জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ পাওয়ার আগেই বাংলাদেশ এই বিশ্ব সংস্থার সব বিশেষায়িত সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সময় আইএমএফ, আইবিআরডি, আইডিএ, ওআইসিসহ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ অর্জন করে বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামি বিশ্বের প্রতিকূল ভূমিকা, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রচারণাসহ নানা কারণে আমাদের সঙ্গে ইসলামি বিশ্বের একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়। তবে বঙ্গবন্ধু এই ব্যবধান বহুলাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হন।
বঙ্গবন্ধুর দক্ষ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শক্তি সঞ্চয় করছিল। জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি, পাকিস্তানসহ অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপন—এ সবই বাংলাদেশকে রুশ-ভারত প্রভাব এড়িয়ে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে সাহায্য করেছিল।
কমনওয়েলথ সম্মেলন, জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, ইসলামি শীর্ষ সংস্থার সম্মেলন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বহুপাক্ষিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
উপমহাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি স্থাপনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী চিন্তার জনক। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই ভাষণে তাঁর শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ রাষ্ট্র-ব্যবস্থার নীতি ফুটে ওঠে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব নেতা। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁর জীবদ্দশায় অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে বাংলাদেশ। শুধু আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কর্মতত্পরতা থেমে থাকেনি। তিনি ছিলেন বিশ্ব শান্তির দূত। এই অঞ্চলসহ পুরো বিশ্বকে একটি শান্তির স্বর্গরাজ্য হিসেবে গড়ে তুলতে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।