রোহিঙ্গাদের ঘিরেই ওরা রাজা-বাদশা

সাখাওয়াত কাওসার, উখিয়া (কক্সবাজার) ॥ রোহিঙ্গাদের পুুঁজি করেই ওরা এখন ‘রাজা-বাদশা’। মাদক এবং চোরাচালানের অর্থে তারা গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। থাকেন অট্টালিকায়। চড়েন আলিশান গাড়িতে। স্থানীয়রা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেই ওরা হয়ে গেছেন ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। কিছুদিন আগেও যারা ছিলেন গাড়ির হেলপার, পানের দোকানদার কিংবা ব্যাটারির পানির ব্যবসায়ী তারা আজ অঢেল সম্পদের মালিক। অনেকটা তাদের ইশারাতেই চলে প্রশাসন। তাদের চোখ রাঙানিতে তটস্থ এলাকার মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে এরই মধ্যে তাদের অনেকেই বনে গেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান এবং মেম্বার। দিনের আলোতে তারা সমাজ সেবক-দানবীর। তবে রাতের আঁধারে ওঠেন ভয়ঙ্কর মানুষ। রোহিঙ্গাদের অপরাধ ওদের কাছে আশীর্বাদের মতো। আবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কাজ করেন এমন অনেকে বলছেন, অনেক দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ী করার জন্য নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতার কারণে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন হোয়াইট কালার ক্রিমিনালদের অনেকে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার রোহিঙ্গাদের জবানিতে উঠে এসেছে তাদের অপকর্মের খবর। তবে কেবলমাত্র তালিকা করেই ক্ষান্ত তারা। কিছুদিন অভিযান পরিচালনা করলেও রহস্যজনক কারণে তা আবার থেমে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, আসলে মাদক নিয়ন্ত্রণে খুব সিরিয়াসনেস দেখানো হলেও কার্যত তা প্রমাণ করা হয় না। কক্সবাজারে দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থা দায়িত্ব পালন করে। তবে সেখানে কীভাবে মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে সে ব্যাপারটিতে কেন জানি রহস্যজনক কারণে দায়িত্বরত সংস্থাগুলো উদাসীন। তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় এমন কোনো ঘর পাওয়া যাবে না, যেখানে কেউ মাদক ব্যবসা করে না। তারপরও আমাদের সংস্থাগুলোর টনক নড়ে না। আমরা এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো রোডম্যাপ তৈরি করতে পারিনি। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী এলাকা থেকে একটি নৌকার মধ্য থেকে ১৪ লাখ পিস ইয়াবা, ১ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকাসহ জহুরুল ইসলাম ফারুক নামে

একজনকে গ্রেফতার করে কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় পরদিন দুটি মামলা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক পুলিশকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা নাগরিক সৈয়দ মাঝি তার অন্যতম সহযোগী। তিনি বেশিরভাগ সময় মিয়ানমারে অবস্থান করেন। তবে মাঝেমধ্যেই চালানসহ কক্সবাজারে আসেন। নিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং কক্সবাজারের অভিজাত হোটেলে অবস্থান করে। উত্তর নুনিয়ারচরা এলাকায় ফারুকের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণাধীন। পুলিশ জানিয়েছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে ফারুক শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। গত চার বছর আগেও উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের ঘিলাতলী গ্রামের বাসিন্দা নাছির উদ্দিন বাদশা ছিলেন পানের দোকানদার। তবে এখন তিনি কোটিপতি। ইয়াবা নামের আলাদিনের চেরাগের স্পর্শে উখিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পেছনে ছয়তলা বিলাস বহুল বাড়ি ছাড়াও রয়েছে তার ১০টির অধিক টমটমের শো-রুম। নামে বেনামে একাধিক জমি ছাড়াও রয়েছে কয়েক কোটি টাকার ব্যালান্স। নিয়মিত উঠাবসা করেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। এ বিষয়ে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি ২০০৮ সাল থেকে টমটমের ব্যবসা করি। ৪০ লাখ টাকার লোন রয়েছে। অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের সিকদার বিলের বাসিন্দা নুর মুহাম্মদ বাদশা।
বাবা সৈয়দ নূর মেকার। পাঁচ বছর আগেও ছিলেন বাসের হেলপার। সে সময় তার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়া-আসা করা অন্য হেলপারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই হেলপার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা পাচার করে আজ কোটিপতি। নুর মোহাম্মদ বাদশা ছিলেন শ্রমিকনেতা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় তিনি এখন বেশ কয়েকটি বাসের মালিক। রয়েছে নামে- বেনামে অগাধ সম্পদ। বাবা সৈয়দ নুর মিস্ত্রি। এ বিষয়ে নুর মোহাম্মদ বাদশার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি ইউনিয়ন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাহাঙ্গীর সাহেবের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। ১১ তারিখের আগে আমি কোনো কথা বলতে পারব না। এর আগে আমাকে ডিস্টার্ব করতে পারবেন না। করলে ভালো হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আপনি তো ৫ মিনিটের বেশি কথা বলে ফেলেছেন এখন আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য দিলেই তো হয়ে যায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আপনি কি অন্য প্রার্থীর পক্ষে তার এজেন্ট হয়ে কাজ করছেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ র্যাবের কাছে গ্রেফতার হয়েছিলেন পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী পূর্বপাড়া এলাকার পালংখালী ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য নরুল আবছার চৌধুরী (৩৫) ও নুরুল আলম চৌধুরী। ২০১৬ সালের ১৮ জুন পালংখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করার জন্য নুরুল আবছার বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কাছে যে হলফনামা জমা দেন, ওখানে তার নগদ মাত্র ১৫ হাজার টাকা ও ব্যাংকে ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জমা থাকার তথ্য দেওয়া হয়। হলফনামায় যে অর্থ উল্লেখ করেছিলেন তিনি, সেটি মাত্র চার বছরে বহু গুণ বেড়ে গেছে।
২০১৬ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মাত্র ৪ বছরে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন এসেছে আবছারের অর্থ-সম্পদে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা আসার পর থেকে। বেশিরভাগ অপরাধ কর্মে তিনি রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেন। হলফনামায় বাড়ির কথা উল্লেখ না থাকলেও বর্তমানে আবছার দুটি তিনতলা বিশিষ্ট ভবন এবং ১টি বিশাল টিনশেড কলোনির মালিক। এ ছাড়া বালুখালী পানবাজারে আবছারের বিশাল মুদির দোকান আছে। আছে একটি নোয়া মাইক্রোবাস, একটি ডাম্পার ও একটি ট্রাক। অভিযোগ রয়েছে, ইয়াবা বহনের জন্য কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে এসব যানবাহনকে ব্যবহার করেন তিনি। তার সহোদর নরুল আমিন চৌধুরী ইতিপূর্বে ইয়াবার চালান নিয়ে ধরা পড়েন। পৃষ্ঠপোষকতা করেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের। এবারও তিনি প্রার্থী হয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে রোহিঙ্গা কিংবা কোনো অপরাধীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। যদি এই রকম কোনো কিছু থেকে থাকে, তাহলে দুদক আছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে তারা ব্যবস্থা নেবে। আমি মাথা পেতে নেব। এখানে জামায়াত-বিএনপির চক্র অনেক শক্তিশালী। তারা আমার বিরুদ্ধে সব সময় ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তাদের কারণেই আমি একবার জেল খেটেছি। করইবুনিয়া রতœাপালংয়ের বাসিন্দা ইকবাল আহমদ (৩০)। বাবা আলী আহমদ। গত পাঁচ বছর আগেও তিনি মানুষের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করতেন। গোপনে ইয়াবা ব্যবসা করে এরই মধ্যে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা রয়েছে ৮টি। একাধিকবার জেল খেটেছেন। জেলা এবং উপজেলা যুবলীগের নেতাদের নাম ভাঙিয়ে এবং উখিয়া থানা ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় চলছে তার মাদক ব্যবসা। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি সততার সঙ্গে অর্থের মালিক হয়েছি। তালিকায় নামের বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আমি মন্ত্রণালয়, রেঞ্জ অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছি। গত সাত বছর আগেও ছোট্ট কাপড়ের দোকান ছিল সালাউদ্দিন আহমেদের। বর্তমানে তিনি রাজাপালং ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি রীতিমতো অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় একাধিক হোটেল-মোটেল ছাড়াও নিজ বাড়ি করেছেন প্রাসাদের মতো।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তালিকায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার নাম রয়েছে। তিনি আগামী ১১ নভেম্বরের নির্বাচনে আবারো প্রার্থী হয়েছেন। তার টার্গেট যে কোনো মূল্যে পুনরায় নির্বাচিত হতে হবে। কৌশল হিসেবে তার নিকটাত্মীয় সাতজনকে ডামি প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নিজেসহ এলাকার অন্য ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তার নির্বাচনে দুই হাতে টাকা খরচ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে তার বক্তব্য, সব অপপ্রচার। তিনি ঠিকাদারিসহ অন্যান্য ব্যবসায় সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিয়মিত কর প্রদান করেন। উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের জাদিমুরার বাসিন্দা কবীর হোসেন। এলাকায় ইয়াবা কবীর নামেই পরিচিত। শূন্য থেকে কোটিপতিদের একজন। ইয়াবা মামলায় জেল খেটেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে সেই একই কারবারে। গায়ে মেখেছেন উখিয়া টেকনাফের সাবেক এক সংসদ সদস্যের পার্টনারের তকমা। জাদিমুরায় রয়েছে তার বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির এক তলার ছাদ ঢালাইয়ের উদ্বোধনের সময় ওই সংসদ সদস্য প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তার বক্তব্য নিতে ফোন দেওয়া হলে, তিনি সবকিছুই অস্বীকার করেন। বলেন, সবই ষড়যন্ত্র। উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এক সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ সহচর আজিজুর রহমান মামুন। উখিয়ায় এলে তার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকেন মামুন। স্থানীয়রা
বলছেন, শুধু তার পেছনে থেকে এবং রোহিঙ্গা অপরাধীদের ব্যবহার করে বেকার থেকে আজ অঢেল সম্পদের মালিক। উখিয়া ঘিলাতলী এলাকার পলিটেকনিক্যাল কলেজের পাশে দুটি বিলাসবহুল ভবন ছাড়াও নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আপনার কাছে কেন আমি উত্তর দেব? আপনি কে? আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন? পারলে আমার ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে দেন। শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়ার অনন্য উদাহরণ হলো রাজাপালং ইউনিয়নের টাইপালং গ্রামের চায়ের দোকানদার নুর আহমদের ছেলে নুরুল আবছার। স্থানীয়রা বলছেন, এক সময়ে তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। গত কয়েক বছরে তার সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এখন তিনি আলিশান জীবন যাপন করছেন। সম্প্রতি উখিয়া টাইপালং রোডে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন পাঁচ তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল ভবন। স্থানীয়রা বলছেন, তার শুরুটা হয়েছে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়। পরবর্তীতে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসার সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে সেই সংসদ সদস্যের আশীর্বাদ। উখিয়া সদরে সরকারি জায়গায় দখল করে করেছেন আবছার ট্রেডার্স নামে বিশাল মার্কেট। এই মার্কেটেরই দ্বিতীয় তলায় রাখা হয়েছে সেই সাবেক সংসদ সদস্যের জন্য রেস্ট রুম। তার বক্তব্য জানতে ফোন দেওয়া হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তার বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র। তিনি বৈধভাবে ব্যবসা করে সম্পদের মালিক হয়েছেন। সরকারকে নিয়মিত কর দেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে থেকে এই দেশে নিজেদের নামে জমি কিনে অবৈধভাবে বসবাস করছে অনেক রোহিঙ্গা। জন্মনিবন্ধন সনদ ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট তৈরিতে জনপ্রতিনিধিরা তাদের সহায়তা করে থাকেন। অনেক রোহিঙ্গা স্থানীয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে নাগরিক অধিকার ও সরকার প্রদত্ত সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের ভোট ব্যাংক, আধিপত্য বিস্তার ও অবৈধ ব্যবসায় তাদের ব্যবহার করে থাকেন। ক্যাম্পে বসবাসরত অনেক রোহিঙ্গা স্থানীয়দের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে মাদক পাচার, অপহরণ, ডাকাতি, পতিতাবৃত্তিসহ নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে নিয়মিত।
কুতুপালং পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা আবদুর রহিম। বাবা মৃত মোহাম্মদ আলী। ৬/৭ বছর আগেও চট্টগ্রামে গাড়ির হেলপার ছিলেন। তবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আসার পরই পোয়াবারো। বর্তমানে তিন তলার আলিশান বাড়ির মালিক। পাঁচটি মিনি ট্রাক ছাড়াও নামে-বেনামে রয়েছে তার বিপুল সম্পত্তি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে সব অপপ্রচার। বৈধভাবেই আমি সম্পত্তির মালিক হয়েছি। এ সব বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ নূর খান লিটন গতকাল বলেন, আমি এখন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছি। আমরা দেখেছি, অনেক সহজ সরল রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে অনেকে বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন- এটা আমরাসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সবাই জানে। তাদের প্রতিরোধে কি কিছু হচ্ছে? আসলে নীতি-নির্ধারক মহলকেও তারা ম্যানেজ করে ফেলছে। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থারও কিছু করার থাকছে না। তিনি বলেন, যারা চিহ্নিত ইয়াবার কারবারি তারা জামিনে এসে জনপ্রতিনিধি বনে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পুনরায় নির্বাচিত হচ্ছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো স্থানীয় এক সাবেক সংসদ সদস্য। তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি কিন্তু তার স্ত্রীকে দিয়ে নির্বাচিত করা হয়েছে। এনজিওদের বিতর্কিত ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়
আইলার সময় আমরা দেখেছি কিছু কিছু এনজিও রিলিফের নামে কীভাবে লুটপাট করেছে। যখন সমাজের বিভিন্ন অংশে পচন ধরে তখন এনজিওতে এর ছোঁয়া লাগতে পারে এটা অস্বাভাবিক নয়। এর জন্য প্রয়োজন আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। জানা গেছে, সৈয়দ নুর বালুখালির বাসিন্দা। মিয়ানমারের নাগরিক হলেও এখন বর্তমানে বাংলাদেশের ভোটার। ইয়াবার কারবার করে বনে গেছেন বিপুল সম্পদের মালিক। বর্তমানে ইয়াবা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। রোহিঙ্গাঅধ্যুষিত কুতুপালংয়ের বাসিন্দা রহমত উল্লাহ কালু। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলেমিশে ইয়াবা কারবার করে কোটিপতি। কুতুপালং বাজারের পাশে বিলাসবহুল ভবন ছাড়াও রয়েছে নামে- বেনামে সম্পদ। মামলা অন্তত পাঁচটি। দুইবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার বক্তব্যও একই রকম। দাবি, তিনি বৈধভাবে সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং ক্যাম্পের একচ্ছত্র অধিপতি বন্দুকযুদ্ধে নিহত বখতিয়ার মেম্বারের ছেলে। বাবার অবর্তমানে হাল ধরেছেন পুত্র হেলাল। একই ওয়ার্ডেই মেম্বার হয়েছেন।
চলেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে। কাজ কারবারও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইয়াবা ব্যবসা, অস্ত্র বাণিজ্য, চাল সিন্ডিকেট, সিএনজি সিন্ডিকেট, টমটম সিন্ডিকেট, বাজার সিন্ডিকেট সবকিছুতে তার হাত। তার মালিকানাধীন বখতিয়ার মার্কেটেই রয়েছে রোহিঙ্গাদের ৮০০-এর উপরে দোকান। বেশিরভাগ দোকানেরই বিদ্যুৎ সংযোগও অবৈধ। কুতুপালং এলাকায় তার বাইরে গেলেই চলে রোহিঙ্গাদের দিয়ে স্থানীয়দের নির্যাতন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কেন্দ্রীয় বাজার ও সিন্ডিকেট থেকেই তার দৈনিক আয় ৫ লাখ টাকা। অল্প বয়সেই গডফাদারের তকমা লেগেছে তার গায়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যকে ম্যানেজ করেই চলছে তার সব কার্যক্রম। এলাকার সাবেক এক সংসদ সদস্যের সঙ্গেও তার রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনো অভিযোগই সত্য নয়। আমার বাবার বিষয়টি ভিন্ন। আমি সন্ত্রাসমুক্ত করার চেষ্টা করছি। বাবার নামে বিদ্যুৎ মিটার ছিল। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বাবার মৃত্যুর সময় তৎকালীন ওসি প্রদীপ আমার নামে একটি মাদক এবং একটি হত্যা মামলা দিয়েছিল। উখিয়া ডেইলপাড়ার বাসিন্দা রফিক উদ্দীন রফু (৫০)। বাবা মৃত বাছা মিয়া। তার ভাই সাবেক মেম্বার মোরশেদ আলম।
কিছুদিন আগেও রফিক কৃষিকাজ করতেন। তবে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে গত দুই বছরে হঠাৎ করেই বনে গেছেন ইয়াবার ডন। তিনি মাদক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। গত বছর থেকে তিন তলা একটি অভিজাত ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে একতলা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, অত্যাধুনিক এই বাড়ি নির্মাণশৈলী এমন যে উখিয়ার লোকজন আগে কখনো দেখেননি। তিনি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন কয়েকবার। তবে অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য হলো, সবই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এর বাইরেও কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার ও পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে আবদুর রহিম, আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দীন, রহিম মেম্বারের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া এমন অভিযোগ রয়েছে, উখিয়ার জাহাঙ্গীর কবির এবং তার ভাই বক্তার আহমেদ, বালুখালীর আবদুল মজিদ, কাস্টমস অফিস উখিয়াঘাটের বুজুরুজ মিয়া, ঘুমধুমের আ. হক, আলী আকবর, নুর হোসেন, আবদুর রশীদ, ইলিয়াস, ফয়সল মেম্বারের বিরুদ্ধে। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার মোহাম্মদ আলী।
নিজের প্রভাব ধরে রাখার জন্য ক্যাম্পে অবস্থানরত বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপকে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা বলছেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলে ইয়াবা পাচার ও বিভিন্ন অবৈধ কাজে জড়িত হয়ে বর্তমানে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ক্যাম্পের পাশেই তার মালিকানাধীন আলিশান মার্কেট। অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান ও কুঁড়ে ঘরে জন্ম নেওয়া মোহাম্মাদ আলী রোহিঙ্গাদের বদৌলতে বর্তমানে অট্টালিকায় বাসিন্দা হয়ে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন। এলাকার বাইরেও রয়েছে তার অনেক সম্পত্তি। তার অন্যতম সহযোগী হলো- ডাকাত। সে স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিক হলেও কাজের সুবিধার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করে। তবে এ বিষয়ে মোহাম্মদ আলীর বক্তব্য হলো, তার বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার। টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত ইলিয়াছের ছেলে এবং স্থানীয় সাবেক এক সংসদ সদস্যের মামাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম। ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ডাকাত দলের অন্যতম সহযোগী ও নিয়ন্ত্রক। বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা ত্রাস ডাকাত আবদুল হাকিমের ছোট ভাই নজির ডাকাতের সঙ্গে তার মেয়ে বিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা ডাকাত দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেন। আলোচিত আবদুল হাকিম ডাকাত ও তার ভাইদের ধরার জন্য আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা একাধিকবার তার বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে। পরবর্তীতে আবদুল হাকিমের দুই ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীসহ মোট তিনজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারায়।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কঠোর অবস্থানে থাকায় সিন্ডিকেট প্রধান আবদুল হাকিম বর্তমানে আত্মগোপনে থাকলেও জাহাঙ্গীর তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে অতি কৌশলে ডাকাত দলের সব অবৈধ কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি কোনো অবৈধ কাজে জড়িত নই। আমার কোনো শত্রু এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারে। আসলে আমি এমনটা নই, লোকাল থানা ও স্থানীয় প্রেস ক্লাবে গিয়ে আমার খবর নিতে পারেন। হ্নীলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাফর ওরফে ইয়াবা জাফর। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক ইয়াবা সিন্ডিকেট গঠন করে এরই মধ্যে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। তিনি ক্রসফায়ারে নিহত নুর মোহাম্মদের অন্যতম সহযোগী। হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালীর মৃত আবদুল মজিদের ছেলে আবুল আলম। কিছুদিন আগেও নুন আনতে পানতা ফুরাতো তার। তবে ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে এখন তিনি অঢেল সম্পত্তির মালিক। পার্শ্ববর্তী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে রয়েছে তার দহরম মহরম সম্পর্ক। সাবেক মেম্বার শফিক আহমদ হত্যায় দীর্ঘদিন পলাতক থাকলেও বর্তমানে এলাকায় ইয়াবা সাম্রাজ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে ১০২ জন ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণে ছিলেন হ্নীলা রঙ্গীখালীর ছেলে শাহ আজম এবং বাবা জামাল মেম্বার। পরে জামিনে এসে আবার জড়িয়ে পড়েন সেই আগের ব্যবসায়। রঙ্গীখালী, আলীখালী, লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইয়াবা সিন্ডিকেটের বড় একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.