ই-কমার্সে নতুন ট্রেন্ড, কেনাকাটায় বেড়েছে নগদ টাকার ব্যবহার

হিটলার এ. হালিম \ দেশে ই-কমার্স নিয়ে সৃষ্ট সংকটের পর নতুন ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে। ই-কমার্সের কেনাকাটায় সিওডি (ক্যাশ অন ডেলিভারি) বা পণ্য হাতে পেয়ে দাম পরিশোধের হার বেড়ে গেছে। আগে যেখানে সিওডির পরিমাণ ছিল ৫০ শতাংশের কম, বর্তমানে তা ৯০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, এই হার আরও বেশি হবে।
যদিও কয়েকজন ই-কমার্স উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, সিওডি বা নগদ অর্থ হাতে পাওয়ার হার বাড়লেও বেড়েছে পণ্য ফেরতের (রিটার্ন) হারও। এখন এই হার প্রায় ২০ শতাংশ। ফলে উদ্যোক্তাদের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিওডি বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তা ও মার্চেন্টরা খুশি। পণ্য বিক্রির অর্থ দ্রæত চলে আসছে হাতে, কিন্তু শুধু নগদ বিক্রিতে ই-কমার্সের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ক্রেতার ঘরে নগদ অর্থ বেশি না থাকায় কেনাকাটার পরিমাণ ও হার দিনে দিনে কমে যাবে। কার্ড ও বিভিন্ন মাধ্যম (এমএফএস সার্ভিস) দিয়ে কেনাকাটার পরিমাণ বাড়াতে হবে। তা না হলে এ খাত দিনে দিনে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে।
ই-ক্যাব (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ই-কমার্সের গ্রাহক দেড় কোটির বেশি। শিগগিরই সংগঠনটি ই-কমার্স গ্রাহক বাড়ানোর জন্য দুই কোটি মানুষকে সচেতন করতে মাঠে নামবে। এতে নতুন গ্রাহক তৈরি হবে বলে মনে করেন সংগঠনের নেতারা।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ই-কমার্স উদ্যোক্তা (আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা) ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘অগ্রিম পেমেন্টের বেলায় ক্রেতাদের আস্থা কমে গেছে। ফলে ক্যাশ অন ডেলিভারি (সিওডি) বেড়ে গেছে।’ তিনি জানান, সার্বিকভাবে সিওডি আগে ছিল ৭০ শতাংশের মতো। বর্তমানে তা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ছোট বড় সব কোম্পানির ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে। তিনি মনে করেন, এটা একদিক দিয়ে ভালো। পেমেন্ট গেটওয়েতে টাকা আটকে থাকছে না। যদিও পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে ই-কমার্সগুলোর টাকা পেতে ৭-১০ দিন লেগে যেতো। তিনি জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রেতা ও মার্চেন্ট; দুপক্ষরই অ্যাডভান্স পেমেন্টের চেয়ে সিওডিতে আগ্রহ বেশি।
ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘ই-কমার্স নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেই উদ্যোগে দেখা যাবে, পেমেন্ট গেটওয়েগুলো ছোটখাটো ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে সেবাই দিতে চাইবে না। যদি সেবা দিতে চায়ও তাহলে পেমেন্ট দিতে দেরি হবে।’ এ বিষয়ে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চালডালের প্রধান পরিচলন কর্মকর্তা জিয়া আশরাফ বলেন, ‘আমরা আগে প্রতিদিন ১১ থেকে সাড়ে ১১ হাজার অর্ডার নিতাম। বর্তমানে তা কমে ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজারে নেমে গেছে। স্বাভাবিকভাবে এটা একটা ধাক্কা।’ তিনি জানান, অন্যান্য ই-কমার্সের মতো চালডালেরও নগদ টাকায় বিক্রি (ক্যাশ অন ডেলিভারি বা সিওডি) বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সিওডির পরিমাণ ৮০ শতাংশের বেশি। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ কার্ড, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে হচ্ছে। তিনি মনে করেন, গ্রোসারির ক্ষেত্রে এটা কোনও সমস্যা নয়। সমস্যা হলো বড় কোনও পণ্য—যার দাম ৫০ বা ৬০ হাজার টাকা, টিভি-ফ্রিজ বা মোবাইল ফোন হতে পারে। নগদে সেসবের দাম দেওয়াও কঠিন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ক্রেতারা ঘরে এত টাকা রাখেন না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রিয়শপ ডটকমের প্রধান নির্বাহী আশিকুল আলম খাঁন বলেন, ‘সব ই-কমার্সে প্রায় ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি ক্যাশ অন ডেলিভারি হচ্ছে।’ তার প্রতিষ্ঠানে সিওডির সংখ্যা ৯৮ শতাংশ বলে জানান। সিওডি বেড়ে যাওয়ায় পণ্য ফেরতের সংখ্যা বেড়েছে। মোট অর্ডারের প্রায় ২০ শতাংশ রিটার্ন (ফেরত) আসছে। সিওডি হওয়ায় ডেলিভারিম্যান ক্রেতাকে না পেয়ে ফিরে আসছে। পরে আবারও যাচ্ছে ডেলিভারি দিতে। এতে পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এসব সমস্যা আস্তে আস্তে বাড়ছে।
তিনি বলেন, ‘পণ্যের অর্ডারও কমে গেছে। এ সংখ্যা আগের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছি, আবার সিওডিকে উৎসাহিত করছি, এটা বেমানান। আমরা আবারও ই-কমার্সের শুরুর দিকে ফিরে যাচ্ছি। কার্ডে বা অন্যান্যভাবে যেন কেনাকাটা করা যায়, সে উপায় বের করতে হবে।’ তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে। অনলাইনের ক্রেতাদের কেনাকাটার ব্যাপারে আস্থা অর্জন করতে হবে। কেনাকাটা ও লেনদেনের নিরাপত্তাজনিত পথও খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমানে প্রতিদিন ২ থেকে আড়াই লাখ প্রোডাক্ট অর্ডার হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনও খাতে অর্ডার বাড়ে, কোনও খাতে কমে।’ এদিকে নতুন আসা ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি সিওডির দিকে। ‘লেট’স গো মার্ট’ নামের ই-কমার্স যাত্রার শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছে—তারা গ্রাহকের পণ্য পৌঁছে দিয়েই মূল্য নেবে। সিওডির মাধ্যমে গ্রাহকের আস্থা তৈরির দিকেই তাদের মনোযোগ। আরেকটি ই-কমার্সের আসার কথা শোনা যাচ্ছে। সেটিও সিওডিকে প্রাধান্য দেবে বলে জানা গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.