হিটলার এ. হালিম ॥ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বাংলাদেশের কথা শোনে না, এটা পুরনো অভিযোগ। এই অভিযোগ ক্রমেই হালকা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ফেসবুক বাংলাদেশের অনুরোধ রাখতে শুরু করেছে এবং এই হার ক্রমেই বড় হচ্ছে। শূন্য থেকে শুরু করে বর্তমানে ৪০ শতাংশ পযন্ত অনুরোধ ফেসবুক রাখছে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। তবে সম্প্রতি এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি বাংলাদেশে ফেসবুকের অফিস স্থাপন এবং কনটেন্ট মনিটরিংয়ের বিষয়ে সরাসরি না করে দিয়েছে। ফেসবুক জানিয়েছে, প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ কনটেন্ট ফেসবুকে আপ হয়, তা মনিটরিং করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোনও কনটেন্ট নিয়ে আপত্তি থাকলে এবং তাদের জানানো হলে, তা তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করেছে কিনা, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অফিস চালু না করা এবং কনটেন্ট মনিটরিংয়ের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন ফেসবুক না করে দেয়, তখন মনে করতে হবে ফেসবুক তাদের লাইনেই হাঁটছে। বাংলাদেশের কথাকে তারা খুব একটা আমলে নিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র আরও জানায়, ওটিটি গাইডলাইন তৈরি করতে বিটিআরসি একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। ওটিটি গাইড লাইনের (রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস-২০২১) খসড়ায় ফেসবুকও মত দিয়েছে। কয়েকটি ধারার বিপরীতে তাদের অবস্থান পরিষ্কার হয়েছে। তারা তাদের মত জানিয়েছে। সেই মতামত কমিটি বিবেচনায় নিয়ে খসড়া চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে। সেই খসড়ায় ফেসবুককে কতটা ছাড় দেওয়া হবে, তা উল্লেখ করা থাকতে পারে।
কমিটির একজন সদস্য নাম পরিচয় উদ্ধৃত না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফেসবুক বাংলাদেশে অফিস করতে চায় না। কনটেন্ট মনিটরিং নিয়েও তাদের অনাগ্রহ রয়েছে। তবে তাদের কাছে কনটেন্ট অপসারণ বা এ জাতীয় কোনও বিষয়ে অনুরোধ করলে, তারা দ্রুত অ্যাকশন নেবে বলে জানিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘২০১৮ সালে এই মন্ত্রণালয়ের যখন দায়িত্ব নিই, তখন ফেসবুকের সঙ্গে যোগাযোগই ছিল না। এর আগে আমরা ফেসবুককে সামাল দিতে পারিনি। ফলে ফেসবুককে বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তখন আমরা ঠিক করি ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, যোগাযোগ বাড়াতে হবে। গত ৪ বছরে ওদের (ফেসবুক) সঙ্গে আমরা অনেকবার বৈঠক করেছি। এখন ওরা আমাদের দেশের আইন-কানুন, আর্থসামাজিক অবস্থা, চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে জানে। আগে ওরা আমাদের ভ্যাট-ট্যাক্স দিতো না, এখন দেয়।’ মন্ত্রী জানান, ফেসবুক বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশাসনিক কাজ করেছে। বাংলাদেশের একজনকে নিয়োগ দিয়েছে, যিনি এখন বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘ওরা আগে বাংলা বুঝতো না। ওদের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে দুটো বিষয় যোগ করা হয়েছে। বাংলা ভাষা যোগ করা হয়েছে। এছাড়া ইংরেজি হরফে বাংলা লেখাও যুক্ত হয়েছে। ফলে বাংলায় ওরা এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। দেখা গেছে, অনেক কিছু যেগুলোর বিষয়ে আমরা অনুরোধ করার আগেই ওরা ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলে। তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ওরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর।’ রোজার আগে ফেসবুক প্রতিনিধি দল টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির সঙ্গে দুইবার বৈঠক করেছে। সর্বশেষ বুধবার (১১ মে) ফেসবুকের একটি প্রতিনিধি দল ডাক ও টেলিযোগোযোগমন্ত্রীর সঙ্গে সচিবালয়ে তার দফতরে বৈঠক করে। বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশে ফেসবুকের কার্যালয় স্থাপনের পরামর্শ দেন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। ফেসবুক বিশ্বের অনেক জায়গায় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ দিয়ে আসছে। তিনি বাংলাদেশেও একই ধরনের সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ প্রদানে ফেসবুকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফেসবুক আপত্তিকর ছবি ও তথ্য-উপাত্তসহ জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশে ব্যবহৃত পোস্ট অপসারণে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে।
এদিকে গাইডলাইনের খসড়া (রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস-২০২১) খসড়া তৈরিকালে বিটিআরসি অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে এবং ওয়েবসাইটে গাইডলাইন প্রকাশ করে মতামতও নিয়েছে। সেসব মতামত পর্যালোচনা করছে বিটিআরসি। খসড়া তৈরির আগে গুগল, দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর সংগঠন অ্যামটব, ফেসবুক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান মতামত ও সুপারিশ দিয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি অন্তত ৪৫টি পয়েন্ট নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। এরমধ্যে ৩৩টি পয়েন্টই ফেসবুকের। এসব পয়েন্টে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার প্রভিশন, বিকল্প ব্যবস্থা, কারণ, প্রস্তাবিত পরিবর্তনের সুবিধাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে (বিশেষ করে ফেসবুক প্রসঙ্গে) জানতে চাইলে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ওটিটি (ওভার দ্য টপ) গাইডলাইন নিয়ে ফেসবুক তাদের মতামত ও পর্যালোচনা দিয়েছে। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো, তাদের দেওয়া মতামত থেকে কতটা রাখতে পারি।’ এসব নিয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারপরও কি ফেসবুক বাংলাদেশের কথা শুনবে? যা বলা হবে সে অনুযায়ী কি কাজ করবে? এ প্রসঙ্গে মন্ত্রীর সাফ জবাব—‘শুরুতে আমাদের অনুরোধের কোনও সাকসেস রেট ছিল না। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে তা বর্তমানে ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, আমরা কোনও অনুরোধ পাঠালে ফেসবুক ৪০ শতাংশের মতো অনুরোধ রাখতে সক্ষম হয়। আশা করি এই হার আরও বাড়বে।’