তাইসলাম॥ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রধান বিচারপতিরা বিচার কাজ ছাড়া পাবলিকলি এত কথা বলেন না বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। বুধবার (২৬ এপ্রিল) সচিবালয়ে আগামী ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এসব কথা বলেন। গত মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) বিকালে হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির একটি বক্তব্যের জবাবে এ মন্তব্য করলেন আইনমন্ত্রী। ওই সংবর্ধনা সভায় প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন ,‘সব সরকারের আমলেই বিচার বিভাগের সঙ্গে বিমাতা সূলভ আচরণ চলে আসছে। প্রশাসন কখনোই চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে চলুক অথচ বিচার বিভাগ প্রশাসনেরও নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। কিন্তু আমলাতন্ত্র সবসময় বিচার বিভাগকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।’
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে প্রধান বিচারপতির ঘন ঘন জনসমক্ষে বক্তব্য দেওয়ারই সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি, অন্য দেশগুলোর প্রধান বিচারপতিরা পাবলিকলি (জনসমক্ষে) এত উষ্মা প্রকাশ করেন না, এত কথা বলেন না। এটা তিনি (প্রধান বিচারপতি) নিজেও জানেন। তিনি তো আমাদের পাশের দেশের প্রধান বিচারপতিকেও দেখছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার যদি কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকে কিংবা কোনও উষ্মা প্রকাশ করার থাকে কিংবা কোনও কথা বলার থাকে, সেটা পাবলিকলি না বলে আমাদের বলুন। আপনার যে কোনও দুঃখ-কষ্ট বা সমস্যার কথা জানতে পারলে আমরা সেই সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ নিতে পারতাম। সমস্যার সমাধান করতে পারতাম।’
এসময় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকার একজন সহকারী জজের বেতন ১৭ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩১ হাজার টাকা করেছে। একজন জেলা জজের বেতন ৪০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৮ হাজার টাকা করেছে। হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির বেতন ৪৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫ হাজার টাকা করেছে। আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির বেতন ৫৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা করেছে এবং প্রধান বিচারপতির বেতন ৫৬ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা করেছে। শুধু তাই নয়, বিচারপতিদের সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে তাদের বাসস্থানসহ সব ধরনের আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও বাড়িয়েছেন। বিচার বিভাগকে সরকার কতটা গুরুত্ব দেয়, এসব উদ্যোগ তারই প্রমাণ বহন করে।’
অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকার বিচার বিভাগের কোনও কাজে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না, অতীতেও করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। এরপরও যদি কেউ বলেন যে বর্তমান সরকার বিচার বিভাগের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছেন, তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।’
এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি বর্তমান সরকার বিমাতাসুলভ আচরণ করছে, এমন কোনও নজির আমি দেখিনি। বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের কোনও বিরোধও আমি দেখি না।’
উল্লেখ্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ে এবং শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য দিয়ে আসছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তার একাধিক মন্তব্য নিয়ে সরকার বিব্রত হওয়ায় দুপক্ষে খানিকটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়।
গত ১৫ এপ্রিল শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মিত ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য আবাসিক ভবন’ -এর উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতিকে দূরত্ব ঘোচাতে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। সেদিন নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দূরত্ব ঘোচাতে আলোচনাকেই সমাধানের রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে কোনও ভুল বোঝাবুঝির সমাধান করা উচিত।’
ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ থাকে। এই তিন অঙ্গ একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করবে। এখানে কে কাকে সম্মান করবে, কে কাকে করবে না, কে কার সিদ্ধান্ত মানবে তা নিয়ে দ্বন্ধ চললে রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সবার কিছু না কিছু ক্ষমতা থাকে। জনস্বার্থে সেই ক্ষমতা আমরা কতটুকু প্রয়োগ করতে পারি আর কতটুকু পারি না তার দিকে খেয়াল রাখা উচিত। ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনস্বার্থকে বিবেচনায় রাখতে হবে।’
এরও আগে ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর দেওয়া এক বাণীতে প্রধান বিচারপতির করা একটি মন্তব্যে সরাসরি দ্বিমত প্রকাশ করতে দেখা গেছে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে। ওই বাণীতে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে। অপরদিকে, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের ধীর গতির অন্যতম কারণ। ১১৬ অনুচ্ছেদের ফলে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে এককভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিচার কাজে বিঘœ ঘটে এবং বিচার প্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়।’
ওই মন্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আগের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বর্তমান সংবিধানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে মাত্র। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শক্তিশালী করতে যা যা করা প্রয়োজন বর্তমান সরকার তা করবে।’