প্রশান্তি ডেক্স॥ ‘বাবা একটু বাইরে যাচ্ছি, এসেই অঙ্কটা শেষ করবো’ বলে ২৩ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়েছিলেন কুমিল্লার ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল। বাবা মজিবুর রহমান তখন ঘুমাচ্ছিলেন, ছেলে তাকে ডেকে বাইরে যাওয়ার কথা বলে বের হয়। সেই ছেলের খোঁজ নেই ১৭ দিন।
গত মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় শিথিলের বাসায় গিয়ে দেখা যায় তার টেবিলের ওপর পড়ে আছে গণিত খাতা। অর্ধেক অঙ্ক করে গিয়েছিলেন তিনি। শিথিলের মা সেই অঙ্ক খাতা বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল শিথিল। তাহলে হঠাৎ কেন চলে গেলো, প্রশ্ন করে নিজেই কাঁদছেন শিথিলের মা।
শিথিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র। তার বাবা একজন শিক্ষক। শহরের শাসনগাছা এলাকায় তাদের বাসা। তার বাবা মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ২৪ আগস্ট থানায় জিডি করেন।
খোঁজ মেলেনি কুমিল্লার সাত শিক্ষার্থীর
শিথিলের মতো কুমিল্লার সাত শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছেন ১৭ দিন ধরে। তাদের একজন নিহাল আবদুল্লাহ। তিনি কুমিল্লা সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। কুমিল্লা শহরের অশোকতলায় তার বাসা। তার মা ফৌজিয়া ইয়াসমিন ২৫ আগস্ট থানায় জিডি করতে গিয়ে থানায় অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা হয়।
আরেক শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইসলাম শিক্ষা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বড় আলমপুর গ্রামের মো. নুরুল ইসলামের ছেলে। শহরের ঝাউতলা এলাকার বাসায় থাকেন।
সরতাজ ইসলাম ওরফে নিলয় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করেছেন। তিনি সম্পর্কে নিখোঁজ নিহালের মামাতো ভাই।
ইমতিয়াজ আহম্মেদ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। তার বাবা মো. ফয়েজ আহম্মেদ কুমিল্লা শহরের শাসনগাছা এলাকায় ব্যবসা করেন। শহরের বাসা বাসায় থাকেন তারা। গত ২৬ আগস্ট থানায় তার বিষয়ে জিডি হয়।
বাকি দু’জন- মো. হাসিবুল ইসলাম ও আস-সামী। তাদের পরিবার থানায় জিডি করেছেন। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি। মোবাইলে কল দিলে কথা বলতে মানা আছে বলে কল কেটে দেন।
এদিকে নিখোঁজ ছাত্র শিথিলের বাবা মজিবুর রহমান বলেন, ছেলেকে খুবই আদর করতাম। কখনও রাগ দেখাইনি। সে খুবই ধার্মিক ছিল, কিন্তু কোনও সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। যাওয়ার আগে একবারও বুঝতে পারিনি সে চলে যাবে। মসজিদে তাবলিগ আসলে সে সেখানে বসতো, কিন্তু কখনও চিল্লায় যায়নি।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, আমরা অভিভাবকরা কেউ কাউকে আগে কখনও দেখিনি। বেশিরভাগের সঙ্গে থানায় মামলা করতে গিয়ে দেখা হয়েছে। আবার কয়েকজনের সঙ্গে র্যাব অফিসে দেখা হয়। কারও সঙ্গে কম্পিউটার দোকানে জিডির কপি টাইপ করতে গিয়েও দেখা হয়েছে। তাই আমাদের চিন্তা হচ্ছে আমাদের ছেলেরা আসলে কীভাবে একসঙ্গে হলো, তাদের বয়সেরও অনেক তফাৎ।
এদিকে ইমতিয়াজ আহমেদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় ইমতিয়াজের থাকার কক্ষে শুয়ে আছেন তার মা। পাশে বসে আছে বাবা মো. ফয়েজ আহম্মেদ। বড় ভাই ইসতিয়াক বসে আছেন ইমতিয়াজের পড়ার টেবিলের চেয়ারে। কেউই জানেন না ইমতিয়াজ ও নিখোঁজ ছাত্ররা কোথায় আছে।
ইমতিয়াজের ভাই ইসতিয়াক বলেন, ছোটভাই অনেকদিন ধরেই অনলাইনে একটা শপ খুলেছে। সে ব্যাগ, জার্সি, টি-শার্ট ইত্যাদি বিক্রি করতো। ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে ভালো কিছু একটা করতে যাচ্ছিল। প্রায়ই সে প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিতে বের হতো। কখনও তাকে চিন্তিত মনে হয়নি। নিখোঁজের অল্প কয়েকদিন আগেও পাঠ্যবই কিনেছে। যদি সে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করতো, তাহলে সে আর বই কিনতো না।
বাবা ফয়েজ বলেন, ইমতিয়াজ শান্ত স্বভাবের ছিল। বাসার পাশেই আমার মুদি দোকান। সে প্রায়ই সেখানে বসতো। তার মামা আমার দোকানেই চাকরি করে। সে তার সঙ্গেই রাতে ঘুমাতো। তার মামাকেও কিছু বলে যায়নি। শেষদিন বের হওয়ার সময় বলেছিল দ্রুতই ফিরে আসবে। রাত ১২টায় ফেরেনি দেখে আমি কল দিলাম, তখন নম্বর বন্ধ পাই। দুইদিন পর ২৬ আগস্ট থানায় জিডি করি। এখনও ছেলেটা ফেরেনি। টেনশনে ঘুম আসে না।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. আফজাল হোসেন বলেন, কোতোয়ালি থানায় ছাত্রদের নিখোঁজের জিডি হয়েছে। আমরা কাজ শুরু করেছি। সারাদেশে পুলিশের একাধিক ইউনিট কাজ করছে। তারা দলবদ্ধভাবে কোথাও গিয়েছে, নাকি অন্য কোনও বিষয় আছে তা তদন্তের পর বলতে পারবো। আমরা চেষ্টা করছি তাদের দ্রুত উদ্ধার করতে।
র্যাব-১১ কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক মেজর মো. সাকিব হোসেন বলেন, অভিভাবকরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। আমরা এখনই তাদের কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলতে চাইছি না। সব বিষয়ে তদন্ত করেই আমরা এগুচ্ছি। তাদের খুঁজে বের করতে সারা দেশে র্যাবের কয়েকটি টিম কাজ করছে। দ্রুতই তাদের খুঁজে বের করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।