বাআ॥ ২০১৩ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে দেশজুগে নাশকতা সৃষ্টি করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সরাসরি নির্দেশে আগ্রাসী কার্যক্রম বাড়াতে থাকে তারা। ফলে মানুষের ঘরে-দোকানে, রাস্তায়, অফিসে, সর্বত্র পেট্রোল বোমা ছুড়ে মানুষ হত্যা করতে থাকে এই দুর্বৃত্তরা। চলন্ত গাড়িতে বোমা ও আগুন দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলে নারী-শিশুদের। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, অফিসফেরত কর্মজীবী কেউ রক্ষা পায়নি বিএনপি-জামায়াতের বর্বরতা থেকে। আগুনে পুড়িয়ে আ পিটিয়ে সহস্রাধিক ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। আর পঙ্গু হয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন কাটাচ্ছেন আরো অনেক মানুষ। পথে বসে গেছে অনেক সচ্ছল পরিবার।
এসব নাশকতার পর পেরিয়ে গেছে অনেক দিন। কিন্তু কেমন আছে নাশকতার শিকার পরিবারের সদস্যরা? কীভাবে চলছে নির্মম হামরায় আহত মানুষদের প্রত্যহিক জীবন? ১১ নভেম্বর (২০২২) তাদের সার্বিক অবস্থার খোঁজ নিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা জানালেন তাদের জীবনের দুঃখগাঁথা।
মাদারীপুরের শিবচরের রুনি বেগম। ঢাকা আসার সময় তার ছেলে নাহিদকে আগুনে পুড়িয়ে মারে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। ২০১৩ সালে শাহবাগে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় নাহিদ। তাকে হাসপাতালে নেওয়াও সুযোগ হয়নি। সন্তান হারানোর পর থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জীবন বহন করে চলেছেন এই মা। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান রুনি বেগম।
গাজীপুর থেকে কাঁচামাল নিয়ে কাভার্ডভ্যান চালিয়ে ঢাকা আসেন ড্রাইভার রমজান আলী। সাথে ছিল ১৪ বছরের ছেলে মনির হোসেন। মালামালা নামানোর পর রাতে কাভার্ড ভ্যানেই ঘুমাচ্ছিলো শিশু মনির। তার চোখের সামনেই অতর্কিত বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয় ভ্যানে। চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো শিশুপুত্র। নিরূপায় হয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না বাবা রমজান আলীর। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। একমুঠো ভাতের জন্য সারাদেশে গাড়ি চালাই। ৩৮ বছর ধরে গাড়ি চালাই। কোথাও কোনো অভিযোগ নাই আমার নামে। কোনো রাজনীতিও করি না। কিন্তু আমার সন্তানকে কেনো মারা হলো এইভাবে। তাহলে কোথায় যাবো আমরা? আমি আর কিছুই চাই না, শুধু এই ঘটনার বিচার চাই।’
বিজিবির সুবাদার নায়েক শাহ আলম। বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য থেকে যাত্রীবাহী বাসকে নিরাপত্তা দিতে কাঁচপুরে ডিউটি পালন করছিলেন তিনি। একসময় জামায়াত-বিএনপির একটি জঙ্গি মিছিল যাচ্ছিলো সেদিক দিয়ে। এরপর কোনো উস্কানি ছাড়াই হুট করে দায়িত্বরত এই বিজিবি সদস্যকে আক্রমণ করে তারা। সাপকে যেমন পিটিয়ে মারা হয়, সেভাবেই পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আমার স্বামীকে। আমার স্বামী তো রাজনীতি করতো না। সে তো দেশের কাজে নিয়োজিত ছিল। আমার সন্তানকে যারা এতিম করলো, তাদের কঠিনতম বিচার চাই আমি। বাবা হারানোর ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছে তারা। আমি ও আমার সন্তানেরা বেঁচে থাকতে সেই হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে চাই।
ট্রাক ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম। ঢাকা থেকে মালামাল নিয়ে যাত্রা করলেন ঠাকুরগাঁর উদ্দেশে। সন্ধ্যায় তিনি যখন দিনাজপুরের কাহারোল থানায়, চারদিক থেকে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। এরপর দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর সাথে দীর্ঘদিন লড়ে কোনোমতে প্রাণে রক্ষা পান তিনি। কিন্তু আগুনে পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন কাটাচ্ছেন।
রফিকুল বলেন, ‘ মির্জা ফখরুলের বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। তার ড্রাইভার বলেছিল- রফিকুল ভাই, আপনি যাবেন না, গেলে আর ফিরে আসতে পারবেন না। কিন্তু আমার কোনো ছেলে নাই। চারটা মেয়ে। তাদের লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য আমি গাড়ি চালাই। আমাকে তাই যেতে হয়েছে। কিন্তু দিনাজপুর পার হওয়ার সময় দেখি হুট করেই ৭-৮টা পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারলো বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। আগুন ধরে গেলো গাড়িতে। মাথার চুলের ওপর দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠছিল। যারা যুদ্ধ দেখেনি, তারা বুঝবে না ওই সময়ের অবস্থা।’
২০০৩ সালের ৬ মে পুলিশ কনস্টেবল জাকারিয়া ডিউটি করছিলেন কাঁচপুরে। ভোরের দিকে তার ওপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে পেটাতে থাকে তাকে। তার স্ত্রী মায়া বেগম জানান, এরপর থেকে অসুস্থ জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হত্যার পর দুই ছেলে অসহায় হয়ে পড়েছে। পরিবার পথে বসে গেছে।
২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল জামায়াত-বিএনপির খুনিরা বাসে পেট্রোল বোমা মারার জন্য ওঁত পেতে ছিল। এসব ছবি তুলেছিলেন ফটো সাংবাদিক আবু সাঈদ তামান্না। একারণে তার দিকে ধেয়ে আসে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা। বেধড়ক পেটায় তাকে। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বাঁচেন তিনি। আবু সাঈদ বলেন, ‘একদিন ভোরে ফোন পেয়ে যাই, যেয়ে দেখি ৭-৮ জন লোক পেট্রোল বোমা বিতরণ করছিল। তারা তা দেখে ফেরে আমাকে ধাওয়া করে, ধরে ছুরিকাঘাত করে ও ইট দিয়ে মাথা থেতলে দেয়। মৃত ভেবে ফেলে রেখে চরে যায়। এরপর থেকে আমি চিকিৎসার ওপরেই বেঁচে আছি। আমি শ্রবণশক্তি হারিয়েছি।’
২০১২ সালে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগদান করেন মকবুল হোসেন। ২০১৩ সালের ২৯ মার্চ রাজশাহীর সাহেববাজারে ডিউটি করছিলেন তিনি। হঠাৎ বিএনপি-জামায়াতের ছোড়া হাতবোমার উড়ে যায় তার দুটি হাত। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন তিনি। মকবুল বলেন, ‘এখনো আমার পিছু ছাড়েনি বিএনপি-জামায়াত নামধারী সাংবাদিকরা। পুলিশের মনোবল ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে তারা।’
বিশ্বাস গ্রুপের মার্কেটিং ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান। কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন যাত্রাবাড়ী থেকে। ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর, ঢাকার মুন্সী আবদুর রব গেটের সামনে তার সিএনজিকে লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছোড়ে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। ঢাকা মেডিক্যালের নিয়ে যাওয়ার পর মারা যায় সে। দুই শিশু সন্তানকে রেখে আমি আর কোথাও যেতে পারিনি। আমার সচ্ছল ও সুখের সংসার ভেসে গেছে। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর দুটি সন্তানকে বড় করার জন্য গার্মেন্টসে কাজ করতে শুরু করি। ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা ডিউটি করে দুই সন্তানকে বড় করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সন্তানের দেখাশোনারও সময় পাই না আর। মায়ের স্নেহ, বাবার আদর ছাড়াই একা একা বড় হচ্ছে তারা।’
২০১৩, ২৮ মার্চ। কোচিং সেন্টারে যাচ্ছিলো শিশু অন্তু বড়ুয়া। বিএনপি-জামায়াতের ছোড়া পেট্রোল বোমায় দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর চোখের আলো ফিরে পেলেও দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফিরে পায়নি সে। একই বছরের ২৪ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীর কোনাবাড়ি এলাকায় বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বাস। ২৯টি যাত্রী গুরুতর আহত হয়। তাদের একজন সালাউদ্দিন ভুইয়া। পুরো শরীর পুড়ে গেছে তার। দগ্ধ হয়ে বদলে গেছে মুখের অবয়ব। তিনি বলেন, ‘আমি খুব সুখী ছিলাম। সুন্দর চেহারা ছিল আমার। বিভিন্ন হাসপাতালে তিন বছরের মতো চিকিৎসা নিয়ে জীবন ফিরে পেয়েছি। কিন্তু এখন চেহারা অন্যরকম হয়ে যাওয়ায় আর কেউ চাকরি দিতে চায় না। আমাকে মানুষ দেখলে ভয় পায় এখন। গাড়িতে উঠলেও আমার পাশের সিটে কেউ বসে না। বাড়িতে মা-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছি সেটা আমি আর আমার পরিবারই শুধু জানে।’
গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানার বামনডাঙ্গার তদন্ত ফাঁড়িতে ডিউটিরত অবস্থায় ছিল পুলিশ সদস্য হযরত আলী। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই ফাঁড়িতে হামলা করে হত্যা করা হয় হযরতসহ চার পুলিশ সদস্যকে। তার স্ত্রী লায়লা বেগম বলেন, ‘ফাঁড়িতে আমার স্বামীসহ ৪ জন পুলিশ ছিল। তাদের সবাইকে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নামে মিছিল দেওয়া লোকজন পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিন বছর বয়সের শিশু সন্তানকে নিয়ে ৯ বছর ধরে যন্ত্রণাকাতর জীবন কাটাচ্ছি। যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, জামায়াত-শিবির-বিএনপির সন্ত্রাসীদের বিচার চাই।’ কনস্টেবল বাবলু মিয়াও জামায়াত-বিএনপির হামলায় মারা যায় সেদিন। তার স্ত্রী জোছনা বেগম জানায়, ‘সেদিন ফাঁড়িতেই ছিল আমার স্বামী। জামায়াত-শিবির মিছিল নিয়ে ফাঁড়িতে হামলা করে আমার স্বামীকে প্রকাশ্যে টুকরো টুকরো করে হত্যা করেছে।
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর শাহবাগের কাছে গাড়িতে বিএনপি-জামায়াতের বোমা হামলায় নিহত হয় কিশোরি নাহিদ। সেই হামলাতেই আহত হয়ে প্রাণে বাছলেও যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন অ্যাডভোকেট খোদেজা নাসরিন আক্তার। তিনি বলেন, কাজ শেষে বাসে উঠেছিলাম বাড়ি ফেরার জন্য। বাসটি শাহবাগের শিশুপার্ক সংলগ্ন স্থানে আসার সময় বাসে আগুন ছুড়ে দিলো। আমার সাথে এক ব্যাংকার নারী ছিলেন। তার শরীরেও আগুন ধরে। আমরা বাসের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে প্রাণ বাঁচাই। ছুটছি তো ছুটছি। হঠাৎ দেখি আমার হাতে আগুন। চামড়া পুড়ে ঝুলে গেছে। এক রিকশাচালক আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। বার্ন ইউনিটের বিশেষ চিকিৎসায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই আমি। এখনো যখন-তখন পোড়া জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি।’
সরকারের পক্ষ থেকে দলমত বিবেচনা না করে, ক্ষতিগ্রস্ত গণমানুষের জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় ভুক্তভোগীরা ধন্যবাদ দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যেন এরকম নাশকতা আর না হয়, সবাই যেনো সমাজে নিরাপদে বাঁচতে পারে, সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা। এছাড়াও তাদের জীবন যারা ধ্বংস করে দিয়েছে, পরিবারকে চিরদুঃখের সাগরে নিমজ্জিত করে দিয়েছে, সেই বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইলেন ভুক্তভোগীরা।